একটি শহরের আত্মকথা
ভূমিকা : পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত আমি। আমি একটি শহর। আমার নাম, আসানসােল। এটি একটি অনার্য নাম। শুকনাে কাঁকুড়ে মাটি, বিস্তর ঝােপজঙ্গল আর উঁচু-নীচু অসমতল ভূমি দিয়ে আমার সর্বাঙ্গ তৈরি। অহল্যা পাষাণ হয়ে বহুদিন নিঃসঙ্গ কাটিয়েছিলাম আমি। অনাদৃত হয়ে পড়েছিলাম বছরের পর বছর। যেন গভীর ঘুমে ঘুমিয়েছিলাম।
শহরের জন্ম : ঘুম ভাঙল গাঁইতি দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির শব্দে এবং বাষ্পীয় রেলইঞ্জিনের ভোঁ শুনে। সে প্রায় দেড়শাে বছর আগেকার কথা। শােনা গেল, রানিগঞ্জে পাওয়া গেছে কয়লার খনি। সে খনির বিস্তার আমার ধারে-কাছে এবং আশেপাশে সর্বত্র। এই কয়লা হল আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার প্রাণভােমরা। দুরদুরান্ত থেকে এসে গেল লােভী বণিকের দল। কয়লা নামক কালাে হিরে সংগ্রহের জন্য তখন সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওই কয়লা জ্বালানাে হবে নতুন নতুন শিল্পকে গড়ে তুলতে। রাজধানী কলকাতা থেকে পাতা হয়ে গেল রেললাইন। আমার বুকে একটি রেলওয়ে ডিভিশন। রেলকর্মীদের জন্য তৈরি হল কয়েক হাজার কোয়ার্টার, অফিস, সেইসঙ্গে এক বিরাট জনবসতিও গড়ে উঠল।
শহর হিসেবে বৃদ্ধি : ওই রেলের ভোশুনেই আমার শহরজীবনের জন্ম। ভোঁ নয়, এটি হল আমার জন্মমুহূর্তের শঙ্খধ্বনি। ভারতের ইতিহাসে আমার আসানসােল নামটি চিরকালের মতাে নথিভুক্ত হয়ে গেল। এরপর থেকে আর আমাকে কখনও পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। কেবল রেলযােগে নয়, আমার বুক চিরে একটি নদীর মতাে চলে গেছে শেরশাহের সেই ইতিহাস-বিশ্রুত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রােড, এটি এখন অন্যতম প্রধান জাতীয় সড়ক।
শিল্পনগরী : সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’-এর সেই বিখ্যাত বাক্যটি এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়। ছিলাম রুমাল, হয়ে গেলাম বেড়াল। ছিলাম কাঠফাটা রােদে পােড়া রুক্ষ পতিত জমি, হয়ে গেলাম এক জনবসতিপূর্ণ কোলাহলমুখর বিরাট শহর। আবার যেমন-তেমন শহর নয়, একেবারে শিল্পনগরী।
জনবসতি ও সহাবস্থান : শােনা যায়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবক্ষয় বাড়ে। আমার বেলায় কিন্তু তা বলা যায় না। আমাকে ঘিরে আজও নতুন নতুন কলকারখানার সৃষ্টি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে শিল্প। রানিগঞ্জ থেকে বার্নপুর, কুলটি সবই আমাকে ঘিরে আবর্তিত। আমাকে ঘিরে শত শত কারখানা। কাগজ তৈরি, সাইকেল নির্মাণ, ওয়াগন তৈরি, গ্লাস ফ্যাক্টরি, ইস্পাত তৈরি এবং এইসঙ্গে খনি থেকে কয়লা উত্তোলন, ওষুধ তৈরি ইত্যাদি অজস্র কাজে লক্ষ লক্ষ লােক এখানে এসে জীবিকানির্বাহ করছে। এখানে সর্বধর্ম, ভাষা, প্রদেশ মিশে একাকার হয়ে গেছে। বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের সহাবস্থানে এখানে এক মিশ্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। মন্দির, মসজিদ সঙ্গে রয়েছে গির্জাও।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার : আমার বুকে গড়ে উঠেছে বিস্তর স্কুল। ইংরেজি-বাংলা-হিন্দি-উর্দু ইত্যাদি ভাষাশিক্ষার ব্যবস্থাও এখানে রয়েছে। রয়েছে একটি মহিলা কলেজসহ আরও দুটি ডিগ্রি কলেজ। কেবল লেখাপড়া নয়, স্বাস্থ্য পরিসেবাও আমার এখানে সহজলভ্য। বড়াে বড়াে হাসপাতাল ও নার্সিংহােমে এই শিল্পনগরী ঠাসা। সব শ্রেণির মানুষের চিকিৎসার সুব্যবস্থা আছে।
উপসংহার : শহর কলকাতা থেকে দূরে পড়ে আছি বলে, আমাকে কখনও যেন অনুন্নত এবং উপেক্ষিত ভাবা না হয়। আমি আসানসােল, পশ্চিমবঙ্গে প্রথম শিল্পনগরী রুপে আমাকে সবাই ভালােবাসে।
আরো পড়ুন
একটি গ্রামের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
একটি নদীর আত্মকাহিনি – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
একটি বটগাছের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
একটি ভাঙ্গা ছাতার আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
একটি রাজপথের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।