একটি ভাঙ্গা ছাতার আত্মকথা
ভূমিকা: চার মাথার মােড়ে ছােটো ছাতা সারাই-এর দোকানের আমি একটি ছাতা। একটু সাবেক কালের। আমার কাপড়ের কালাে রং রােদে পুড়ে, জলে ভিজে ফ্যাকাসে আর ধূসর হয়ে এসেছে। লােহার শিক বা উঁটির অবস্থাও তথৈবচ। বয়সের ভারে আমি বেশ একটু নড়বড়েই হয়ে পড়েছি। তাই বেশিরভাগ সময়েই মনের দুঃখে দোকানের এককোণে পড়ে থাকি। আর মনে মনে নিজের পুরােনাে কেতাদুরস্ত জীবনের কথা ভাবি। তবে মাঝেমধ্যে আমার ভাগ্যেও শিকে ছেঁড়ে। মানে দোকানে কেউ ছাতা সারাতে দিলে মিস্ত্রিদাদা আমাকে দু-এক দিনের জন্য তাদের বাড়ি পাঠায়। তখন হঠাৎ হারানাে যৌবন ফিরে পেয়ে খুশিতে মনটা ডগমগ করে ওঠে। ফের আবার ব্যথায় ভরা দেহে যন্ত্রপাতির পাশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকি। এ-বাড়ি থেকে সে-বাড়ি ঘুরে বেড়াই। কখনও আনন্দ নিয়ে ফিরে আসি, কখনও-বা দুঃখ।
জন্ম ও অতীত ইতিহাস : আমার জন্ম তালপুকুরের একটি ছাতার কারখানায়। সেখান থেকে ঝকঝকে সুন্দর হয়ে এসেছিলাম দোকানে, বেশ ছিলাম। রােদ লাগে না, বৃষ্টি লাগে না, নিশ্চিন্ত হয়ে দোকানের কাচের শােকেসে সাজানাে থাকতাম। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ এসে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে, ফের রেখে দিয়ে চলে যায়। এভাবেই দিন কাটে। তবে একদিন অপেক্ষার শেষ হল। এক ভদ্রমহিলা কিনে নিলেন আমায়। অচেনা পথে পাড়ি দিলাম আর বুঝলাম আমার কাজ শুরু হবে এবার। তিনি আমাকে বাড়ি নিয়ে এসে তার মেয়ের হাতে তুলে দিলেন। মেয়েটি বেজায় খুশি। আমারও ছােট্ট সঙ্গিনীর আদরে-যত্নে দিব্যি দিন কাটে। কিন্তু কয়েকদিন যেতে-না-যেতেই মেয়েটি আমায় বাসে ফেলে এল। কিছুক্ষণ নির্জনে পড়ে থাকার পর আমি গিয়ে পড়লাম একজন লােকের হাতে। লােকটি আমায় হাতে পেয়ে কৌতুকবশে একবার খােলে আর একবার বন্ধ করে। এরপর নেড়েচেড়ে দেখে সে আমার নাম রাখল ছত্রসুন্দরী। এমন পছন্দসই নাম পেয়ে সেদিন আমার যে কী গর্ব হয়েছিল, সে আর কী বলব!
জীবনযাত্রা ও পরিণাম : বছর চারেক কেটে গেছে রােদে তেতে আমার সুন্দর কালাে রং ইতিমধ্যে ফ্যাকাসে হয়ে এল। দিন কাটতে লাগল অবহেলায়। তখন বারবার মনে হত মানুষেরা আমার ছত্রছায়ায় রােদবৃষ্টির হাত থেকে আরাম পায়, আর আমি নির্বাক হয়ে পড়ে থাকি। আমি নিরুপায়। এইভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। আমি ছত্রসুন্দরী’ ভিজে-তেতে পড়ে থাকতাম ওই লােকটির ঘরের এক কোণে। একদিন হঠাৎ করে বৃষ্টি এল। লােকটিকে বাইরে কাজে যেতেই হবে। সে আমায় সঙ্গে নিল। কিন্তু বৃষ্টির ঝাপটায় লড়তে না-পেরে একটু পরেই আমি উলটে গেলাম। সেদিন সে আমায় সারাতে দিল এই দোকানে, তবে আর নিতে এল না। কুড়িয়ে পাওয়া ছত্রসুন্দরী’ বলেই হয়তাে আমার এই দশা হল। সেই থেকে আমি এই মিস্ত্রিদাদার দোকানে পড়ে আছি। বদলির কাজ করি তাে তাই খুব একটা যত্ন পাই না। বুঝলাম আমার সময় এসেছে! মনকে তৈরি করলাম। এরপর একদিন এক কাগজ কুড়ুনির কাছে সে আমাকে পাঁচ টাকায় বেচে দিল। এইভাবে সময়ের শব্দ গায়ে মেখে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেলাম।
আরো পড়ুন
একটি বটগাছের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
একটি রাজপথের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
প্রতিযোগিতার সুফল ও সংকট – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
মিড-ডে মিল – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
সর্বশিক্ষা অভিযান – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।