জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা

ভূমিকা: রামপ্রসাদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন—“এমন, মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলতাে সােনা।” এই পৃথিবীতে যে মানুষ, সকলের শুভ আকাঙ্ক্ষার প্রতীক-অপরাজেয় পৌরুষের অধিকারী-মনুষ্যত্বের সাধক; তাঁদের জীবন ও জীবনভাবনাই আমাদের প্রতিনিয়ত পথ দেখায়। তাদের মহৎ জীবনের কথা স্মরণ করে আমরা সংগ্রহ করে থাকি আমাদের চলার পাথেয়, দিশাহীনতার অন্ধকার থেকে আলােকরেখার সন্ধান পাই। এক বাঙালি কবির কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়েছে এই কথারই প্রতিধ্বনি—“মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়,/সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয়কীর্তি ধ্বজা ধরে/আমরাও হব বরণীয়।”

জীবনচরিত পাঠের প্রাসঙ্গিকতা : ভালাে খেলতে হলে যেমন দক্ষ খেলােয়াড়ের খেলার পদ্ধতি জানা দরকার, ভালােভাবে অভিনয় করতে গেলে যেমন প্রকৃত অভিনেতার কাছে পাঠ নিতে হয়, তেমনই সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে চাইলে মনীষীদের জীবন থেকে শিক্ষালাভ করতে হয়। জীবনচরিত পাঠের প্রাথমিক উপযােগিতাটুকু এইখানেই নিহিত থাকে। মানুষের মুক্তির পথ খুঁজতে কপিলাবস্তুর শাক্যবংশীয় যুবরাজ পথে নেমে এসেছিলেন, মানুষের চেতনার ত্রাণকর্তা হয়ে জিশুখ্রিস্ট আত্মদানেও কুণ্ঠিত হননি; একইভাবে শ্রীচৈতন্য-কবির-নানক থেকে শুরু করে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ মানুষকে সর্বস্ব উজাড় করে ভালােবাসার শিক্ষা দিতে গিয়ে সর্বত্যাগী হয়েছেন। নিজ লক্ষ্যে স্থির থাকতে গিয়ে অবিশ্বাসীর আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছেন জোন অফ আর্ক। তেমনি মার্টিন লুথার থেকে রামমােহন, বিদ্যাসাগর কিংবা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল বা ভগিনী নিবেদিতা বা ক্ষুদিরাম-সূর্যসেন-গান্ধিজি ও নেতাজিদের জীবনের টুকরাে কাহিনি আজ কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, পরিণাম নয় আমাদের বিবেচনায় পথটিই হল আসল। কারণ আমরা সকলেই হয়তাে ঈশ্বরচন্দ্র বা মহাত্মা গান্ধি হব না। কে কী হতে পারব তা আগে থেকে স্থির করাও সম্ভব নয়। তবে এদের জীবনের আসল শিক্ষা হল জীবনের সত্যস্বরূপ এবং চলার পথটিকে চিনে নেওয়া। কোনটা মনুষ্যত্ব আর কোনটা নয়, কিংবা কোনটা গ্রহণ করব আর কোনটা বর্জন এইটুকু স্থির করে নেওয়ার জীবনে বড়াে প্রয়ােজন আছে। এই জন্যেই রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষকে অনেক সাধনায় মানুষ হতে হয়। জীবনের চলার পথে ছােটো-বড়াে আঘাত, অপবাদ, ছলনা অমিত শক্তির উৎসে রূপান্তরিত করতে জানতে হয়। লাঠি হাতে ধাবমান শীর্ণ, প্রত্যয়দৃপ্ত বৃদ্ধটিকে দেখে যখন ‘যদি তাের ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলাে রে’ শুনি, তখন আমরা জীবনের একাকিত্ব ও বেদনাকে প্রকৃত ভালােবাসতে শিখি ৷

উপসংহার: শিক্ষালাভ করার জন্যেই জীবনচরিত পাঠ করব এমনটা কিন্তু সত্যি নয়। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ এক মহাজীবনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ লাভ করাই হল এর উদ্দেশ্য। তাকে এক মুহূর্তে বুঝে ফেলার স্পর্ধাটুকু দূরে সরিয়ে, জীবনকে পরিপূর্ণভাবে সদব্যবহার করে এই তুচ্ছ-ক্ষুদ্র জীবনকে কীভাবে অনন্ত জীবনে পর্যবসিত করা যায়, সেই উপলব্বি মনের মধ্যে জাগিয়ে তােলাই হল জীবনচরিত পাঠের মূল অভিপ্রায়। যেন মানবজীবনের মহিমাকে সমগ্রভাবে অনুভব করে বারবার নতুন করে জেগে ওঠা। জেগে উঠে একজন মানুষকে স্পষ্টরূপে দেখা আর তাঁর মধ্যে নিজেদের সত্যমূর্তিকে আবিষ্কার করার মধ্যেই জীবনচরিত পাঠের সার্থকতা প্রতিভাত হয়ে ওঠে।

আরো পড়ুন

রক্তদান জীবনদান – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

দেশ ভ্রমণের উপযোগিতা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

একটি গ্রামের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

একটি শহরের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

একটি নদীর আত্মকাহিনি – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

Read More »

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment