যজমানি ব্যবস্থা বলতে কী বােঝায় ? যজমানি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি সংক্ষেপে আলােচনা কর। ৩+৫ Class 12 | Sociology (ভারতীয় সমাজ) 8 Marks
উত্তর:
যজমানি ব্যবস্থা হল ভারতীয় গ্রামীণ সমাজের এক অভিনব আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। ভারতীয় সমাজের সনাতন যজমানী ব্যবস্থাহল পূর্বনির্ধারিত একশ্রমবিভাজন ব্যবস্থা। জাতিগত বিচারে এইশ্রমবিভাজন ব্যবস্থা ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্যের দ্বারা স্বীকৃতি ও সমর্থিত। প্রকৃত প্রস্তাবে যজমানী ব্যবস্থা ভারতের গ্রামাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ড।
যজমানী ব্যবস্থায় ভূস্বামী পরিবারের সঙ্গে ভূমিহীন পরিবার সমূহের এক স্থায়ী প্রকৃতির সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। ভূমিহীন পরিবারগুলি ভূস্বামী পরিবারকে দ্রব্য-সামগ্রী ও বিবিধ পরিষেবা প্রদান করে। এই ব্যবস্থাকে বলে যজমানী ব্যবস্থা।
যােগেন্দ্র সিং-এর অভিমত অনুযায়ী যজমানী ব্যবস্থা হল গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনুসৃত এক ব্যবস্থা। এই সম্পর্ক পারস্পরিক অধিকার-কর্তব্যের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। যজমানী ব্যবস্থা হল জাতগােষ্ঠীসমূহের মধ্যে দেওয়া-নেওয়ার এক বিশেষ সম্পর্ক।
যজমানী কথাটি একটি বৈদিকশব্দ, যার অর্থ হল পৃষ্ঠপােষকতা (patron)। প্রাক-বৃটিশ স্বনির্ভর গ্রামীণ বাজারবিহীন ও মুদ্রাবিহীন পরিস্থিতিতে দুটি পরিবারের দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ককে ভিত্তি করে পেশাভিত্তিক জাতিগুলির যে বংশ পর্যায়ক্রমিক বিনিময় প্রথা গড়ে উঠেছিল, তাকেই আপাত অর্থে যজমানী প্রথা বলে গণ্য করা হয়। এখানে যাঁরা সেবা গ্রহণ করেন তাঁরা “যজমান” (Jajman) এবং যারা সেবা দান করেন তাঁরা “কামিন” (Kamin) হিসাবে পরিচিত।
যজমানী প্রথার বৈশিষ্ট্য : যজমানী ব্যবস্থার ধারণা ও চেহারা-চরিত্র বিচার বিশ্লেষণ করলে এর কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায় :
(১) যজমানী প্রথার উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এটি নৈর্বক্তিক, অলিখিত নিয়মের অধীন। বাজার অর্থনীতির অনুপস্থিতিতে এই প্রথাকে মেনে এটি একটি অভিনব প্রকৃতির আর্থসামাজিক ব্যবস্থা।
(২) এটি একটি সর্বভারতীয় প্রথা বিশেষ।
(৩) দুটি স্বতন্ত্র দ্রব্য উৎপাদনকারী পরিবার বা পেশাভিত্তিক দ্রব্য-উৎপাদক পরিবারের দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে যজমানী প্রথা আবর্তিত হত। ধারাবাহিক সেবা দান ও গ্রহণের মাধ্যমে এটি অবস্থান করত।
(৪) যজমানী প্রথা ছিল বংশ পরম্পরা ভিত্তিক। অর্থাৎ দুটি পেশাভিত্তিক জাতির বংশানুক্রমিক বিনিময় ছিল যজমানী প্রথার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
(৫) এই ব্যবস্থায় যে বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল তাতে সেবা গ্রহণকারী যজমান এবং সেবাদানকারী কামিনদের আদান-প্রদানের মধ্যে মুদ্রার পরিবর্তে দ্রব্য প্রদানের নীতিই মুখ্য ছিল। যজমানী ব্যবস্থায় পরিষেবার পারিশ্রমিক দ্রব্যসামগ্রীতে দেওয়া হয়।
(৬) উইলিয়াম এইচ ওয়াইজার (W. H. Wiser) প্রমুখ মনে করেন যজমানী প্রথা হল একটি শান্তি ও সহযােগিতার মাধ্যম। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও এর দ্বারা সুনির্দিষ্ট হত।
(৭) যজমানী ব্যবস্থা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করত।
(৮) যজমানী ব্যবস্থার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল এই ব্যবস্থায় যজমান ও কামিনদের মধ্যে যে সম্পর্ক বর্তমান থাকে তা বহুলাংশে স্থায়ী প্রকৃতির। ফলে গ্রামের অর্থনৈতিক কাঠামাে স্থায়িত্ব লাভ করে, গ্রামগুলির স্বয়ংসম্পূর্ণতা অটুট থাকে।
(৯) যজমানী ব্যবস্থায় সকল ধরনের কামিনের কাজকর্মের পরিধি ও সুযােগ সমান হয় না। এ ক্ষেত্রে ব্যাপ্তি ও প্রকৃতিতে পার্থক্য দেখা যায়। সকল গ্রামে সকল রকম কামিন থাকে না বা পাওয়া যায় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, কোনও গ্রামে নাপিত না থাকার জন্য সেই গ্রামের যজমানরাপাশের গ্রামে গিয়ে বা পাশের গ্রামের নাপিতকে দিয়ে ক্ষৌরকর্ম করান।
(১০) যজমানী ব্যবস্থায় গ্রাম ও গ্রামের অধিবাসীদের শান্তি ও সন্তুষ্টি সুনিশ্চিত হয়। এই ব্যবস্থায় কামিনদের মধ্যে এক নিরাপত্তাবােধ পরিলক্ষিত হয়।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।
যজমানি প্রথা ভেঙে পরার কারন গুলি কি ?
উত্তর:
যজমানি প্রথা ভেঙে পড়ার কারণ: নিম্নলিখিত কারণে যজমানি প্রথা ভেঙে পড়ে
১. সময়ের বিবর্তনে কৃষির বাণিজ্যিকরণ,
২. শিক্ষার প্রসার,
৩. পেশাগত সচলতা বৃদ্ধি,
৪. জায়গিরদার প্রথার অবলুপ্তি,
৫. নগরায়ণ,
৬. বাজার অর্থনীতির উদ্ভব,
৭. সর্বোপরি শিল্পায়ন – প্রভৃতি কারণে যজমানি প্রথা ক্রমশ হীনবল হতে হতে হারিয়ে যেতে বসেছে।
যজমানি ব্যাবস্থা পরিবর্তনের কারণ কি?