যৌথ পরিবারের সুবিধা-অসুবিধা আলােচনা কর

যৌথ পরিবারের সুবিধা-অসুবিধা আলােচনা কর Class 12 | Sociology (সামাজিক কাঠামোগত পরিবর্তন) 8 Marks

উত্তর:

যৌথ পরিবারের বিবিধ সুবিধা : 

যৌথ পরিবার ব্যবস্থার বহু ও বিভিন্ন সুবিধা বর্তমান। নিম্নলিখিত সুবিধাগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

(ক) আর্থনীতিক অগ্রগতির সহায়ক : দেশ ও দেশবাসীর আর্থনীতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে যৌথ পরিবার ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য। উদ্বৃত্ত ও সম্পদ আর্থনীতিক সমৃদ্ধি সমষ্টিগত-আয়ােজনের মাধ্যমেই সম্ভব। এই সুবিধা যৌথ পরিবারের মধ্যে পাওয়া যায়। যৌথ পরিবার ব্যবস্থা বণিকগােষ্ঠীর বিকাশ ও বিস্তারে সাহায্য করেছে। ভারতে বিভিন্ন আমলে আর্থনীতিক ও বাণিজ্যিক উদ্যোগ-আয়ােজনের ক্ষেত্রে যৌথ পরিবার ব্যবস্থার সদর্থক ও সক্রিয় অবদান অনস্বীকার্য।

(খ) ব্যয়সংকোচ : যৌথ পরিবার ব্যবস্থার আর একটি বড় সুবিধা হল ব্যয়সংকোচ। যৌথ পরিবারব্যবস্থার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কমখরচে পরিবারের সকলের ভরণ-পােষণ সম্ভব হয়।

(গ) সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সুবিধাভােগ : যৌথ পরিবারব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পদ-সামগ্রীর ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুসরণ করা সম্ভব হয়। এই ধরনের পারিবারিক সংগঠনে সকলে নিজ-নিজ সামর্থ্য অনুসারে আয় করে, এবং প্রত্যেকে প্রয়ােজন অনুসারে ভােগ করে। পরিবারের সকল সদস্যের রােজগার পরিবারের সাধারণ তহবিলে জমা পড়ে। পরিবারের বয়ােজ্যেষ্ঠ পুরুষ সদস্যের নিয়ন্ত্রণাধীনে এই তহবিল পরিচালিত হয়।

(ঘ) সুনাগরিকের সৃষ্টি : যৌথ পরিবার ব্যক্তির সামাজিক গুণাবলী ও সুকুমার বৃত্তিসমূহের যথাযথ বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে সহযােগিতা, সহমর্মিতা, স্বার্থত্যাগ, উদার হৃদয়বত্তা প্রভৃতি গুণাবলী যৌথ পরিবারের মধ্যেই ব্যক্তি অর্জন করার সুযােগ পায়। এইভাবে যৌথ পরিবারের পরিকাঠামােতে সুনাগরিকদের সৃষ্টি হয়। 

(ঙ) কৃষি-অর্থনীতির মেরুদণ্ড : যৌথ মালিকানার কারণে যৌথ পরিবারে কৃষিজমির বিখণ্ডিত হওয়ার আশংকাকে আটকানাে যায় এবং আর্থনীতিক দিক থেকে লাভজনক উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যায়। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে যৌথ পরিবার একটি যৌথ মূলধনী প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। অনেকের মতানুসারে যৌথ পরিবারপ্রথা হল কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ডস্বরূপ।

(চ) শ্রমবিভাগের সুবিধা : যৌথ পরিবারে শ্রমবিভাগের সুবিধা পাওয়া যায়। পরিবারের প্রত্যেকের জন্য সাধ্য ও সামর্থ্য অনুসারে কাজের দায়িত্ব বণ্টিত থাকে।

(ছ) অবকাশযাপনের সুযােগ : যৌথ পরিবারব্যবস্থায় সদস্যরা পর্যাপ্ত অবসরযাপনের সুযােগ পায়। পরিবারের মহিলারা তাদের যাবতীয় কাজকর্ম নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়। তারপর মহিলাদের অখণ্ড অবকাশযাপনের সুযােগ সৃষ্টি হয়। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযােজ্য।

(জ) সামাজিক নিরাপত্তা : সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে যৌথ পরিবারের ভূমিকা অনন্য। দুর্যোগ-দুঃসময়ে যৌথ পরিবারের কোনাে সদস্য অসহায় হয়ে পড়ে না। যৌথ পরিবারের সকল সদস্যের জীবন, সম্মান, সম্পদ ও নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। বার্ধক্য, অসুস্থ ও অসমর্থ অবস্থায় পরিবার থেকেই প্রয়ােজনীয় পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হয়।

(ঝ) আর্থনীতিক সংহতি : যৌথ পরিবারব্যবস্থা সুদৃঢ় আর্থনীতিক সংহতির উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেকের রােজগার পরিবারের আয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রত্যেকের প্রয়ােজনপূরণের ব্যবস্থা হয় এই পারিবারিক রােজগার থেকে। এমনকী বেকার বা কমআয়ের ব্যক্তিকেও দুঃখ-কষ্ট ভােগ করতে হয় না।

(ঞ) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী স্বার্থপরতা নিয়ন্ত্রণ : যৌথ পরিবারব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী স্বার্থপরতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না।

(ট) পারিবারিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ : যৌথ পরিবারব্যবস্থার মাধ্যমে ভালাে পারিবারিক প্রথা, রীতিনীতি, ঐতিহ্য অব্যাহত রাখা ও সংরক্ষণ সহজে সম্ভব হয়।

যৌথ পরিবারের অসুবিধা (Disadvantages of Joint Family) :

সাম্প্রতিককালের পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায় যৌথ পরিবারের সীমাবদ্ধতা এর জনপ্রিয়তা তথা অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। যৌথ পরিবারব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। 

(ক) ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে অন্তরায় : যৌথ পরিবারব্যবস্থার মধ্যে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফুর্ত বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরিবারের কর্তার নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশ সকলের ক্ষেত্রেই শিরােধার্য। 

(খ) শ্রমবিমুখতা প্রশ্রয় পায় : যৌথ পরিবারব্যবস্থায় অলস ও অকর্মণ্যরা প্রশ্রয় পায়। এই ধরনের পারিবারিক কাঠামােতে কিছু মানুষ কোনােরকম কাজকর্ম না করেই অলসভাবে জীবন-যাপনের সুযােগ পায়।

(গ) ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি : যৌথ পরিবারব্যবস্থায় ঝগড়া-ঝাটির বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত ভ্রাতৃবধূদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ঈর্ষা-কলুষিত হয়ে থাকে। পরিবারের অসংখ্য ছেলেমেয়ের মধ্যে ছােটোখাটো বহু ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ, মনােমালিন্য প্রভৃতি লেগেই থাকে। ছােটদের বিবাদ সূত্রে অনেক সময় বড়দের মধ্যে কলহ শুরু হয়।

(ঘ) মামলা-মােকদ্দমার সৃষ্টি : যৌথ পরিবারের যৌথ সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারার প্রাক্কালে সাধারণত মতপার্থক্য ও বিরােধ-বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সালিশীর মাধ্যমে এই বিরােধের মীমাংসা সম্ভব হয় না। তখন আইন-আদালতের সাহায্য নিতে হয়। 

(ঙ) মূলধন সঞ্চয়ের প্রতিবন্ধক : যৌথ পরিবারের কোনাে সদস্যই তার সমগ্র রােজগার স্বয়ং ভোগ করতে পারে না, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে বণ্টনের পর সংশ্লিষ্ট সদস্য তার অংশ পায়। এই অবস্থায় সঞ্চয় বড় একটা সম্ভব হয় না। তাছাড়া যৌথ পরিবারের সম্পত্তি যৌথ মালিকানাধীন থাকে বলে সম্পত্তির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হয় না; সম্পত্তির অপচয় হয়, সম্পত্তি নষ্ট হয়।

(চ) নববধূদের প্রতি অবিচার : বিবাহের পর বন্ধু হিসাবে যারা পরিবারে প্রবেশ করে পরিবারের সকলের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তাদের উদয়াস্ত প্রাণপাত করতে হয়। বয়ােজ্যেষ্ঠ মহিলাদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। স্বামীর সঙ্গে স্বাধীনভাবে মত বিনিময় বা অবসর বিনােদনের সময়-সুযােগ সে পায় না।

(ছ) পরিবার পরিকল্পনার পরিপন্থী : যৌথ পরিবারব্যবস্থায় পরিবারের যে-কোনাে দম্পতির সন্তানের লালন-পালন ও লেখা-পড়ার দায়িত্ব পরিবারই গ্রহণ করে। এই অবস্থায় পরিবার পরিকল্পনার ইচ্ছা বা উদ্যোগ যৌথ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দেখা যায় না।

(জ) দারিদ্র্য ও দুগর্তির সৃষ্টি : অনেকের অভিযােগ অনুসারে যৌথ পরিবারব্যবস্থা হল দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। যৌথ পরিবারের যৌথ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়ােজনীয় তদারকির ব্যাপারে কর্তাব্যক্তি ছাড়া পরিবারের সাধারণ সদস্যদের তেমন আগ্রহ বা আন্তরিকতা থাকে না। ফলে এই সম্পত্তির অবক্ষয় ও অপচয় ঘটে।

(ঝ) সামাজিক সচলতার অভাব : সামাজিক সচলতার ক্ষেত্রে যৌথ পরিবার-ব্যবস্থা প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। যৌথ পরিবার সদস্যদের প্রয়ােজনীয় নিরাপত্তা প্রদান করে। এই সমস্ত কারণে যৌথ পরিবারের সদস্যরা অন্য জায়গায় যেতে চায় না।

(ঞ) ব্যক্তিগত গােপনীয়তার অভাব : যৌথ পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত গােপনীয়তার অভাবও অনস্বীকার্য। স্বামী-স্ত্রী স্বাভাবিকভাবে মেলামেশার সুযােগ পায় না।

(ট) রক্ষণশীলতা : যৌথ পরিবারব্যবস্থা হল একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত ব্যবস্থা। এই যৌথ পরিবার প্রকৃতিগত বিচারে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ও গোঁড়া।

(ঠ) পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় : পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় স্ত্রী বা নারীদের ভূমিকা যৌথ পরিবারে থাকে না বললেই চলে; স্বামীর বা পুরুষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে পরিগণিত হয়।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

2 thoughts on “যৌথ পরিবারের সুবিধা-অসুবিধা আলােচনা কর”

Leave a Comment