প্রশ্ন -মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ, প্রসার ও ফলাফল আলােচনা করাে। 8 Marks | Class 10
ভূমিকা : সহজ, সরল কৃষিজীবী মুন্ডা উপজাতির মানুষরা বিশ্বাস করতেন তারাই জমির সত্যিকারের মালিক। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের পর মুন্ডাদের জমি থেকে উৎখাত করা হলে মুন্ডারা । বিদ্রোহের (১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ) পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। |
বিদ্রোহের কারণ : মুন্ডা বিদ্রোহের কারণগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে—
১। জমির ওপর অধিকার হারানাে : ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হলে। বাইরের থেকে লােভী মানুষেরা মুন্ডাদের জমি জায়গা কুক্ষিগত করে নিতে থাকে এবং মুন্ডাদের বিতাড়িত করে সেই জমিগুলি | দখল করে নিলে মুন্ডারা ক্ষুব্ধ হয়।।
২। খুৎকাঠি প্রথার অবসান : ব্রিটিশরা মুন্ডাদের ঐতিহ্যবাহী | ‘কাঠি’ প্রথা বা জমির ওপর যৌথ মালিকানার অবসান ঘটিয়ে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করলে মুন্ডারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
৩। নতুন আইনবিধি : ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হলে মুন্ডাদের | চিরাচরিত মুন্ডারি, আইন, বিচার ও সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে নতুন ধরনের আইন প্রবর্তিত হলে মুন্ডারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
৪। ধর্মান্তরিতকরণ : খ্রিস্টান মিশনারিরা ছলে-বলে-কৌশলে, লােভ দেখিয়ে ধর্মভীরু মুন্ডাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে থাকলে মুন্ডা সমাজ বিদেশিদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্দ হয়।।
৫। বেগার শ্রম : নিরীহ মুন্ডাদের দিয়ে সরকারি কর্মচারী, জমিদার, মহাজন বিনা মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করত। দিনের পর দিন তারা মুখ বুজে ‘বেঠবেগারি’ অর্থাৎ বেগার খেটে অবশেষে বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।
৬। বীরসা মুন্ডার ভূমিকা : ধর্মপ্রচারক হিসেবে জীবন শুরু করলেও বীরসা মুন্ডার সংস্কারমূলক বিবিধ ব্যবস্থা, হীনম্মন্যতাকে দূর করে মুন্ডাদের মাথা উঁচু করে বাঁচার শিক্ষা মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
৭। অন্যান্য কারণ : এ ছাড়াও মহাজন, জমিদার, জায়গিরদার, ঠিকাদার, চা ব্যবসায়ীদের মিথ্যা প্রলােভন ও শােষণ এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
বিদ্রোহের সূচনা :
নেতৃত্ব লাভ : বীরসা প্রাথমিক পর্বে ইংরেজি শিক্ষা লাভ করে খ্রিস্টধর্মের অনুরাগী হলেও পরবর্তীকালে স্বধর্মের মূল স্রোতে ফিরে আসেন এবং স্বজন-স্বজাতির দুর্দশার জন্য ব্রিটিশদের শােষক চরিত্রটি তার সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময় সরকারের বনবিভাগ মুন্ডাদের পতিত জমিগুলিকে অধিগ্রহণের চেষ্টা করলে বীরসা সমবেতভাবে তার বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন (১৮৯৩ খ্রি.)।
মুন্ডা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান : ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ সংগঠিত করার অপরাধে বীরসা মুন্ডা জেলবন্দি হন এবং মুক্তিলাভের পর তিনি জমিদার, মহাজন, পাদরি, ঠিকাদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুন্ডাদের পুনরায় সংগঠিত করেন। এরপর ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে। ভগবানের দূত’ (ধরতি আবা’) প্রচার করে মুন্ডাদের ত্রাণকর্তারূপে। বিদ্রোহ ঘােষণা করে মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন (১৮৯৯ খ্রি.)। শেষপর্যন্ত ইংরেজ পুলিশবাহিনীর হাতে তিনি ধরা পড়েন ও রাঁচি জেলে তার মৃত্যু হয় (১৯০০ খ্রি.)।
ফলাফল : মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী, কারণ— (১) এর ফলে মুন্ডাদের জমিতে ‘খুঁৎকাঠি স্বত্ব পুনঃপ্রবর্তিত হয়; (২) ব্রিটিশ সরকার ছােটোনাগপুর অঞ্চলের জন্য ছােটোনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে এবং সেখানে আলাদা। প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। (৩)‘বেঠবেগারি’ নিষিদ্ধ হয় এবং (৪) বীরসা সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
উপসংহার : ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে, সর্বভারতীয় – জাতীয়তাবাদী চেতনায় মুন্ডা বিদ্রোহ তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও পরাধীন ভারতে বিশেষত ছােটোনাগপুরে মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার জন্য | বীরসার নেতৃত্বে মুন্ডারা সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতার নমুনা রেখেছেন।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।