পারস্যের ক্ষত্ৰপ ও চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার বর্ণনা দাও।

পারসিক শাসনব্যবস্থার প্রশাসনিক একক হিসাবে ক্ষত্ৰপ বা স্যাট্রাপ ও সাম্রাজ্যিক চিনেব ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে। [৪+8] 
অথবা, পারস্যের ক্ষত্ৰপ ও চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার বর্ণনা দাও। [একাদশ বার্ষিক ২০১৬]
Xi History Questions Answers

উত্তর:

সূচনা :- কোনাে দেশের শাসনতান্ত্রিক চরিত্র রাজতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক- যাই হােক না কেন, দেশের প্রশাসনযন্ত্র পরিচালনার জন্য শাসন সংগঠনের প্রয়ােজন। এই শাসন সংগঠন গড়ে ওঠে একদল দক্ষ প্রশাসকের সমন্বযে ৷ অতীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠা সুবিশাল সাম্রাজ্যের শাসকরা তাদের সাম্রাজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এই রকম বহু শাসন-সংগঠন গড়ে তুলেছিল। যার মধ্যে অন্যতম ছিল পারস্যের ‘স্যাট্রাপ’ (ক্ষত্রপ), চিনের ‘ম্যান্ডারিন, ব্যবস্থা প্রভৃতি। এই সংগঠনগুলি সংশ্লিষ্ট দেশের শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

পারস্যের স্যাট্রাপ বা ক্ষত্রপ :- প্রথম পারস্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সাইরাস দ্য গ্রেট (৫৫০-৩৩০ খ্রীস্টপূর্ব) প্রাচীন সুবিশাল আর্কিমেনীয় বা পারস্য সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সাম্রাজ্যকে ক্ষুদ্র-বৃহৎ কয়েকটি প্রশাসনিক এককে বিভক্ত করেন। এই এককগুলিই ‘স্যাট্রাপি’ নামে পরিচিত ছিল। তিনি প্রতিটি স্যাট্রাপিতে একজন কবে গভর্নর বা শাসনকর্তা নিয়ােগ কবেন, যাঁরা ‘স্যাট্রাপ বা ক্ষত্ৰপ’ নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রীক শব্দ ‘স্যাট্রাপিয়া’ শব্দ থেকে ‘স্যাট্রাপি’ শব্দটির উৎপত্তি হযেছে। প্রাচীন পারসিক ব্যাখ্যানুসারে ‘স্যাট্রাপশব্দটির অর্থ হল সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা। স্যাট্রাপ’ শব্দের বর্তমান আভিধানিক অর্থ হল প্রাচীন পারস্যের প্রাদেশিক শাসনকর্তা। মহান সাইরাস এই ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলেও দারায়ুসের আমলে ক্ষত্রপ ব্যবস্থার প্রশাসনিক ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। সাইরাস তাঁর সাম্রাজ্য শাসনের জন্য ২০ জন ক্ষত্র নিয়ােগ করলেও দারায়ুসের আমলে সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি পেলে ক্ষত্রপের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়।

ক্ষত্ৰপ বা স্যাট্রাপদের কার্যাবলি :- স্যাট্রাপির প্রধান শাসনকর্তা হিসাবে ক্ষত্রপদের বেশ কিছু কাজ করতে হত। যেমন —

১) সামরিক দায়িত্ব পালন : স্যাট্রাপরা সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে একটি সৈন্যবাহিনী রাখতেন। তারা সৈনিক নিয়ােগ, সামরিক ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিবােধ করতেন। 

২) বিদ্রোহ দমন : তারা স্থানীয় শাসক হিসেবে বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন করতেন। বিশৃঙ্খলা দূর কবে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। 

৩) বাজস্ব আদায় : স্যাট্রাপকে তাঁর সংশ্লিষ্ট শাসনাঞ্চল থেকে কর আদায় কবে সেই অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারি কোষাগারে জমা করতে হত। 

৪) বিচারকার্য : স্যাট্রাপির প্রধান প্রশাসক হিসেবে স্যাট্রাপরা পৌর ও ফৌজদারী উভয় অপরাধের বিচার করতেন।

৬) আমলা নিযােগ : প্রদেশ বা আঞ্চলিক কাজের প্রয়ােজনে তাঁরা স্থানীয় আমলাদের নিয়ােগ করতেন। 

৭) নিরাপত্তা প্রদান : রাস্তায় যাতায়তের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও তাঁদের করতে হত। 

ক্ষত্রপদের সঙ্গে সম্রাটের সম্পর্ক :- ক্ষত্রপরা প্রদেশগুলিতে শাসনক্ষমতা ভােগের অধিকারী হলেও তাঁরা নিজেদের কাজের জন্য সম্রাটের কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে সম্রাটের সম্পর্ক নির্ভর করত সামরিক শক্তি ও রাজকীয় কর্তৃত্ব পালনের ওপর। তাই সম্রাটরা ক্ষত্রপদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেন। যেমন —

১) পর্যবেক্ষক : “রাজার নয়ন” নামে পরিচিত পর্যবেক্ষকগণ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্যাট্রাপিতে ঘুরে ঘুরে স্থানীয় প্রশাসন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং তা সম্রাটকে জানাতেন। 

২) সতর্কীকরণ : স্যাট্রাপগণ তাঁদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে এবং তাঁদের শাসনাঞ্চলের বাৎসরিক বিবরণ নির্দিষ্ট সময়ে সম্রাটের কাছে জানাতে ব্যর্থ হলে সম্রাট প্রথমে স্যাট্রাপদের সতর্ক কবে দিতেন।

৩) পদচ্যুতি : সতর্কীকরণ কোনাে কাজ না হলে সম্রাট স্যাট্রাপির দায়িত্ব থেকে তাঁদের পদচ্যুত করতেন। 

মূল্যায়ন :- প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ক্ষত্ৰপরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এই ব্যবস্থার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। যেমন—

১) পরবর্তীকালে ক্ষত্রণ পদগুলি বংশানুক্রমিক হওয়ায় প্রশাসনে অযােগ্য ব্যক্তির প্রবেশ ঘটে। 

২) কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযােগে ক্ষত্রপদের কেন্দ্রীয় শাসনকে অগ্রাহ্য করার প্রবনতা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রাদেশিক শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। 

৩) ক্ষত্ৰপরা স্বাধীনতার জন্য বারবার বিদ্রোহ করলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

গুরুত্ব :- বিভিন্ন ত্রুটি থাকা সত্বেও পারসিক সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় ক্ষত্রপদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ক্ষত্রপদের দক্ষতার উপরে সাম্রাজ্যের ভালাে-মন্দ নির্ভর করত। পারসিক সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতিতেও এদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

চিনের ‘ম্যান্ডারিন ব্যবস্থা :- চিনে মাঞ্চু রাজবংশের শাসনকালে প্রদেশ থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে যে আমলাতান্ত্রিক গােষ্ঠী প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকত, তাদের বলা হত ম্যান্ডারিন। ‘ম্যান্ডারিন’ একটি মালয়’ শব্দ। এই শব্দটির অর্থ যে কোন স্তরের উচ্চপদস্থ কর্মচারী । কিন্তু এখানে ম্যান্ডারিন বলতে চিনের উচ্চপদস্থ পন্ডিত কর্মচারীদের বলা হয়েছে। চিনে আঞ্চলিক শাসনের স্তম্ভ ছিল এই ম্যান্ডারিন শ্রেণি

ম্যান্ডারিনদের যােগ্যতা :-ম্যান্ডারিন পদে নিয়ােগ করার সময় বংশমর্যাদা ও সম্পত্তির পরিবর্তে যােগ্যতা ও শিক্ষাদীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হত l ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীকে কাব্য, সাহিত্য, কনফুসীয় ধর্মে দক্ষ, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও চিনের ধ্রুপদী ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক ছিল । যােগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় প্রার্থীকে পাস করতে হত। অন্যদিকে পাহারাদার, অপরাধী, জেল খাটা আসামি, শ্রমিক, অভিনেতা, সঙ্গীতজ্ঞ, ক্রীতদাস ও ভিক্ষুকরা ম্যান্ডারিন পদে নিয়ােগের পরীক্ষায় বসতে পারত না।

নিযােগ ও পদচ্যুতি :- পরীক্ষায় সফল প্রার্থীদের সম্রাট কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক সরকারের কর্মচারী নিয়ােগ করতেন। তাদের স্থায়িত্ব ও পদচ্যুতি সম্রাটের ইচ্ছার উপর নির্ভর করত। তাদের মধ্যে আঞ্চলিক সংকীর্ণতা দূর করার জন্য তাদের নিজের এলাকার বাইরে নিয়ােগ করা হত।

মর্যাদা :- চিনা সমাজে ম্যান্ডারিনরা ছিলেন খুবই সম্মানীয় । চিং বংশের রাজত্বকালে ম্যান্ডারিনদের মর্যাদা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। তাঁরা অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। সােনা, রুপা ও মূল্যবান রত্নখচিত পােশাকও পরতেন ।

শ্রেণিবিভাগ :- ম্যান্ডারিনরা তিনটি স্তরে বিভক্ত ছিল। যথা- (i) উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিন , (ii) সাধারণ ম্যান্ডারিন ও (iii) নিম্ন শ্রেণির ম্যান্ডারিন | উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিনরা প্রধানমন্ত্রীর সমকক্ষ পদ বা প্রাদেশিক গভর্নরের পদে নিযুক্ত হতেন। তাঁরা পদ্মরাগ মণিযুক্ত বিশেষ ধরনের টুপি ব্যবহার করতেন। সাধারণ ও নিম্নশ্রেণির ম্যান্ডারিনরা প্রবাল , লাপিস , লাজুলি , সােনা প্রভৃতির দ্বারা তৈরি টুপি ব্যবহার করতেন।

ম্যান্ডারিনদের কাজ :- ম্যান্ডারিনরা চিনা প্রশাসনের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেন । —

ক) প্রশাসনিক কাজ :  প্রশাসনের প্রধান আমলা হিসেবে যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করতেন।

খ) সম্রাটকে সহায়তা : উচ্চশ্রেণির ম্যান্ডারিনরা রাজকার্যে রাজাকে সাহায্য করতেন।

গ) নিরাপত্তা রক্ষা : মধ্য ও নিম্ন শ্রেণীর ম্যান্ডারিনরা প্রদেশে বা স্থানীয় অঞ্চলগুলির শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন।

ঘ) বাণিজ্যের তদারক : ম্যান্ডারিনরা চীনে বাণিজ্য, অর্থ, আইন, বিচার, বিদেশ দপ্তর ইত্যাদি পরিচালনা করতেন।

ঙ) অন্যান্য কাজ : চিনের ঐতিহ্য রক্ষা করা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকের প্রতি নজর রাখতেন ম্যান্ডারিনরা । ম্যান্ডারিনরা তাদের ভালাে কাজের জন্য সম্রাট বা উৰ্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পুরস্কৃত হতেন l শুধু তাই নয়, এর বিনিময়ে তারা রাজকোশ থেকে ভালাে বেতন পেতেন।

গুরুত্ব :- চীনের প্রশাসনিক সাফল্যে ম্যান্ডারিনদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। যেমন-

১) চিনের প্রশাসনিক সাফল্য ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল ।

২) ম্যান্ডারিনরা সম্রাটের সঙ্গে চিনের আঞ্চলিক শাসকদের যােগসূত্র গড়ে তােলে।

৩) ম্যান্ডারিনদের তত্ত্বাবধানে চিনের নিরাপত্তা সুদৃঢ় হয় এবং বাণিজ্যের উন্নতি ঘটে।

৪) ম্যান্ডারিনদের কঠোর পরিশ্রমে চিনা প্রশাসনে গতি আসে ।

ম্যান্ডারিন প্রথার অবসান :- চীনে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ম্যান্ডারিনরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও একথা ঠিক যে, 1729 খ্রিস্টাব্দে গ্র্যান্ড কাউন্সিল গঠিত হলে ম্যান্ডারিনদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব অনেকখানি হ্রাস পায়। শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্য শিক্ষা ধারার চাপে চিনে 1905 খ্রিস্টাব্দে ম্যান্ডারিন নিয়ােগ সংক্রান্ত পরীক্ষার অবসান ঘটে এবং 1911 খ্রিস্টাব্দে কিং (চিং) বংশের পতনের পর চিনে সমগ্র ম্যান্ডারিন প্রথার অবসান ঘটে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!