প্রাক ব্রিটিশ ভারতের সামাজিক শ্রেণীসমূহের উপর সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ | এই প্রসঙ্গে দাস ব্যবস্থা প্রসঙ্গে লেখ। ৫+৩ Class 12 | Sociology (ভারতীয় সমাজ) 8 Marks
উত্তর:
প্রাক ব্রিটিশ ভারতের সামাজিক শ্রেণীসমূহ (Social Classes in Pre-British India) :
প্রাক্-ব্রিটিশ-ভারতের সামাজিক কাঠামাে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কিছু ছিল, এমন কথা বলা যায় না। মুঘল আমলেও সাবেকী ধারা ও আধুনিকতার স্বাভাবিক সহাবস্থান অস্বীকার করা যায় না। ভারতীয় সভ্যতাসংস্কৃতির একটা মূলধারা সব আমলেই অল্পবিস্তর অব্যাহত আছে। মুঘল আমলের ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতি বা জনজীবনের কাঠামাে একেবারে অন্যরকম কিছু ছিল, এমন ধারণা অমূলক।
সম্রাট : মুঘলযুগে সম্রাট স্বয়ং সমগ্র সমাজের শীর্ষদেশে বিরাজমান ছিলেন। মুঘল-ভারতে সম্রাটের অবস্থান ছিল সর্বোচ্চ। তিনি ছিলেন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। সমকালীন ভারতীয় সমাজ ছিল প্রকৃতিগত বিচারে সামন্ততান্ত্রিক।
অভিজাত গােষ্ঠী : উধ্বাধঃ বিন্যাসে তারপরেই ছিল অভিজাতদের অবস্থান। অভিজাতদের একটি গােষ্ঠীকে বলা হত ‘খানজাদা’। এবং অপর গােষ্ঠীকে বলা হত ‘শেখজাদা’। মুঘল আমলের একেবারে গােড়ার দিকে অভিজাতের মর্যাদা পেত শুধুমাত্র বহিরাগত মুসলমানরা। এই অভিজাত গােষ্ঠী খানজাদা’ অভিধায় অভিহিত হত। বহিরাগত মুসলমানদের মধ্যে আবার দুটি গােষ্ঠী ছিল। একদলকে বলা হত ‘ইরানী’ এবং আর একদলকে বলা হত তুরানী। মুঘল সম্রাটের অভিপ্রায় অনুযায়ী যে-কোনাে মানুষের পক্ষে অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল। কিছু হিন্দুও অভিজাত মর্যাদা লাভ করেছে। এই দ্বিতীয় গােষ্ঠীর অভিজাতরা ‘শেখজাদা’ অভিধায় অভিহিত হতেন। হিন্দুদেরও আকবর অভিজাত গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই হিন্দু অভিজাতরা হলেন বীরবল, টোডরমল, মানসিংহ, ভগবানদাস প্রমুখ। ঔরঙ্গজেবের আমলেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। সে সময় ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে মুঘল সম্রাটের কর্তৃত্ব কায়েম হয়। তখন ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অভিজাত-মর্যাদা প্রদান করেন এবং তাদের মুঘল দরবারে জায়গা করে দেন।
মধ্যবিত্ত শ্রেণি : মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে সাধারণভাবে স্বাধীন বৃত্তিজীবী ব্যক্তিবর্গকে বােঝায়। মধ্যবিত্তরা বিত্তবান নন, কিন্তু আর্থিক সামর্থ্যে সচ্ছল। তাছাড়া মধ্যবিত্তরা মােটামুটি শিক্ষিত। অনেকে মনে করেন যে, সমকালীন দিল্লিতে ধনী ও দরিদ্র, শুধুমাত্র এই দুটি শ্রেণির মানুষের বসবাস ছিল। কোনাে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল না। কিন্তু এখনকার ইতিহাসবিদরা এ কথা পুরােপুরি মেনে নিতে নারাজ। মুঘল যুগের সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। সে সময় ভারতে অভিজাত বা উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির অন্তর্বর্তী আর একটি শ্রেণির মানুষ ছিল। এদেরই মধ্যবিত্ত বলা যায়। মুঘল রাজত্বে উচ্চপদস্থ ওমরাহ বা অভিজাত গােষ্ঠীর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের আমলা, রাজস্ব আদায়কারী, হিসাবরক্ষক প্রভৃতি কর্মীমণ্ডলী ছিল। মুঘল শাসকদের বিশাল প্রশাসনিক কাঠামাের অন্তর্ভুক্ত কর্মীমণ্ডলীর একটি উল্লেখযােগ্য অংশ বৃত্তিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। সে সময় চিকিৎসকদেরও ভালাে পসার ছিল। এদের আর্থিক অবস্থাও ছিল বেশ সচ্ছল। তাছাড়া তখন ভূমিস্বার্থভিত্তিক একটি শ্রেণি ছিল। সমকালীন বাংলায় এদের বলা হত ‘তালুকদার, বিহারে বলা হত ‘মুকাররিদার’, উত্তরপ্রদেশে বলা হত ভূমিহার’ এবং দক্ষিণ ভারতে বলা হত ‘মিরাজদার’। এদের অবস্থান ছিল প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদারশ্রেণি ও শ্রমজীবী কৃষকশ্রেণির মধ্যবর্তী পর্যায়ে।
নিম্নস্তরের সাধারণ মানুষ : অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরেই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। সামাজিক স্তরবিন্যাসে এদের অবস্থান ছিল নিম্নস্তরে। এই শ্রেণির মধ্যে ছিল কৃষক, শিল্পী-কারিগর, গৃহভৃত্য, দোকানদার, ক্রীতদাস প্রভৃতি বিভিন্ন কাজের মানুষ। তখন চাষ-আবাদের উপায়-পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত অনুন্নত। কৃষকদের যাবতীয় সাজসরঞ্জাম ছিল মােটামুটি আদিম প্রকৃতির। কৃষিকাজ ছিল প্রকৃতপক্ষে পুরােপুরি প্রকৃতির আনুকূল্যের উপর নির্ভরশীল; অর্থাৎ অনিশ্চয়তাপূর্ণ। সর্বোপরি কৃষকদের উপর সমকালীন জমিদারদের শােষণ ছিল সীমাহীন। স্বভাবতই কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশার শেষ ছিল না। শিল্পী-কারিগর বা কারুশিল্পী শ্রমিকদের অবস্থাও ভালাে ছিল না। দোকানদারদের, বিশেষত ছােট ছােট দোকানদারদের অবস্থা ছিল অতি সাধারণ। অনুরূপভাবে গৃহভৃত্যদের অবস্থাও ভালাে ছিল না। এদের অবস্থা দাসদেরই সমপর্যায়ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়।
কৃষকদের শ্রেণিবিভাগ : মুঘল আমলে কৃষির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিবর্গকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এই চারটি শ্রেণি হল : (ক) খুদকাস্তা’, (খ) পাছিকাস্তা বা উপরি’, (গ) মুজরিয়ান’ এবং (ঘ) ভূমিহীন কৃষক।
(ক) খুদকাস্তা : খুদকাস্তা বলতে সেই সমস্ত কৃষকদের বােঝাত যারা নিজেদের বসত-গ্রামেই কৃষিকার্য করত। এই শ্রেণির কৃষকদের জমিতে দখলীস্বত্ব ছিল।
(খ) পাছিকাস্তা বা উপরি : এই শ্রেণির কষকরা চাষ-আবাদ করত বসত-গ্রামের বাইরে গিয়ে অন্য জমিতে। এদের কৃষিকর্মের সাজসরঞ্জাম থাকত না।
(গ) মুজারয়ান : এই শ্রেণির কৃষকরা অন্যের জমিতে ভাগচাষ করত।
(ঘ) ভূমিহীন কৃষক : ভৃত্যের ন্যায় ভূমিহীন কৃষকরা অপরের চাষ-আবাদে সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করত। এরা উৎপাদিত শস্যের একটা অংশ পেত।
দাসব্যবস্থা : ভারতে দাসব্যবস্থা অনেকাংশে সহনশীল অবস্থায় ছিল বলে মনে করা হয়। যুদ্ধবন্দীদের বা অধিকৃত অঞ্চলের অধিবাসীদের দাস হিসাবে ক্রয়বিক্রয় নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সম্রাট আকবর উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি আইনও জারি করেছিলেন। স্বভাবতই আকবরের আমলে দাসব্যবস্থা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ছিল। ভারতের হিন্দু ও মুসলমান, এই দুই গােষ্ঠীর মানুষই দাসব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বহির্ভারতের দাস-ব্যবসায়ীদের মধ্যে মগ, পর্তুগিজ, ও আরাকানীদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ভারতের ভিতর থেকে এবং বহির্ভারত থেকে দাস সংগৃহীত হত। বিদেশি দস্যুরা শক্তিপ্রয়ােগ করে গায়ের জোরে দাস সংগ্রহ করত। ভারতের বাজারে দাসদের বিক্রি করা হত। বিদেশী দস্যুরা পূর্ব ভারতের যে সমস্ত জায়গা থেকে দাস সংগ্রহ করত তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ওড়িশার উপকূলবর্তী অঞ্চল এবং হিজলি, বাকলা, বাকরগঞ্জ, যশােহর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল।
ভূমিদাস-প্রথা : ভূমিদাসরা ছিল ভূমিহীন। তারা জীবন ও জীবিকার জন্য ভূস্বামীর জমিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করত এবং ফসল উৎপাদন করত। এই শ্রেণির মানুষের বৃত্তি বাছাই করার বা প্রভু স্থির করার স্বাধীনতা ছিল না। নিজ নিজ এলাকার ভূস্বামীদের কাছে এদের দায়বদ্ধ থাকতে হত। শুধুমাত্র গ্রাসাচ্ছাদনের সুযােগ এরা পেত।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।