রবীন্দ্রনাথের রূপক সাংকেতিক নাটক

রবীন্দ্রনাথের রূপক সাংকেতিক নাটক

উত্তর : 

রবীন্দ্রনাথের রূপক সাংকেতিক নাটক

বর্তমানে রূপক-সাংকেতিক নাটক নামে নাটকের একটি প্রকরণের কথা বলা হলেও রূপক ও সংকেত কথা দু’টি এক নয়। রূপক বলতে আমরা সেই ধরণের কাহিনিকে বুঝি যার আপাত একটি কাহিনি ভিতরে | একটি গভীর তাৎপর্যবাহী কাহিনি লুকিয়ে থাকে। আর সংকেত হল কোন চিহ্ন বা প্রতীকের দ্বারা কোন বিষয় সম্পর্কে ব্যঞ্জণাকে ফুটিয়ে তােলা। তবে সাহিত্যিকরা বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই নাটকে রূপক কাহিনির অবতাড়ণা করে তার মধ্যে নানা সংকেত ব্যবহার করেছেন জন্য সেই নাটকগুলিকে একসাথে রূপক-সাংকেতিক নাটক বলা হয়। তবে বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের আগেই ইয়েটস, মেটারলিঙ্ক, স্টিল্ডবার্গ, হুইপ্টম্যান প্রমুখেরা রূপক-সাংকেত নির্ভর নাটক রচনা করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। মূলতঃ এদের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকটি রূপক-সাংকেতিক নাটক রচনা করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তার প্রধান পরিচয় কবি হিসাবে হলেও বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য, বাংলা উপন্যাস, বাংলা ছােটগল্প, বাংলা গান প্রভৃতি প্রকরণেও সমানভাবে পদচারনা করার পাশাপাশি বাংলা নাটকেও তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য রচনার পর বেশ কয়েকটি নিয়মানুগ নাটক ও ব্যঙ্গকৌতুক নাটক রচনা করেছিলেন। তবে বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব তার রূপক-সাংকেতিক নাটকগুলির জন্য। রবীন্দ্রনাথ যে সকল রূপক-সাংকেতিক নাটক লিখেছেন সেগুলি হল- ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮), “রাজা” (১৯১০),-এর | অভিনয়যােগ্য সংস্করণ ‘অরূপরতন’ (১৯২০), ‘অচলায়তন’ (১৯১২)-এর সংক্ষিপ্ত সংস্করণ ‘গুরু’ | (১৯১৮), ‘ডাকঘর’ (১৯১২), ফাল্গুনী (১৯১৪), ‘রক্তকরবী’ (১৯২৬), ‘মুক্তধারা (১৯২৬), ‘কালের যাত্রা’ (১৯৩২), ‘তাসের দেশ’ (১৯৩৩)।

বােলপুর আশ্রমে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে শারদোৎসব উপলক্ষে ছাত্রদের দ্বারা অভিনীত হবার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শারদোৎসব’ নাটকটি রচনা করেন। এই নাটকটিতে ঋণশােধের পটভূমিকায় প্রকৃতির সঙ্গে মানব মনের মিলন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে রাখালী ধরণের পটভূমিকায় বুদ্ধিগ্রাহ্য তত্ত্ব প্রকাশ করা হয়েছে। তবে অনেকের মতে ‘শারদোৎসব’ নয়, ‘রাজা’ নাটক থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত রূপক-সাংকেতিক নাটকের যাত্রা শুরু। বৌদ্ধ কুশজাতক থেকে কাহিনি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অপূর্ব নাটকীয় মুহূর্ত সৃষ্টি করে ধ্যাণগম্ভীর পরিবেশ ও নিগুঢ় আধ্যাত্মিক সংকেতের সাহায্যে নাটকটি রচনা করেছেন। ভগবানকে রূপের মধ্যে পাওয়া যায়না, সীমাবদ্ধ প্রতীকের মধ্যে তিনি ধরাছােয়ার বাইরে থেকে যান, যে সীমাবদ্ধ রূপের মাঝে অরূপকে পেতে চায়, অবশেষে চোখের জলের মধ্যে তাকে পেতে হয় রবীন্দ্রনাথ এই তত্ত্বই এই নাটকটিতে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এ নাটকের চরিত্ররা হল— অন্ধকার ঘরে বদ্ধ রাজা, রানী সুদর্শনা, ঠাকুরদা, সুরঙ্গমা প্রভৃতি। রাজা’ নটকের ইংরেজি অনুবাদ ‘The King of Dark Chamber’ সারা বিশ্বে সাফল্যের সাথে অভিনীত হয়।

প্রাচীন কালের তন্ত্রমন্ত্রের পটভূমিকায় প্রথা ও সংস্কারের চাপে কিভাবে মনবাত্মার স্বাধীন প্রকাশের বিলােপ ঘটে এবং তা থেকে মুক্তিলাভ করা যায় রবীন্দ্রনাথ এই তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন তাঁর ‘অচলায়তন নাটকে। এই নাটকে দেখা যায় এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিভাবে বিভিন্ন রীতি সংস্কার দ্বারা শিক্ষার্থীদের মনের স্বাধীণ বিকাশকে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছিল। সেখানেই মুক্তির বাণী নিয়ে হাজির হয় পঞ্চক। এই পঞ্চকের কারনেই শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তাদের আত্মার মুক্তির সন্ধান পায়।

রূপক-সাংকেতিক নাটকের ধারায় রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ‘ডাকঘর’। এই নাটকটি ‘The Post Office’-নামে সারা বিশ্বে সাফল্যের সাথে অভিনীত হয়েছে। এখানে রূপকের আড়ালে ঈশ্বরের সাথে মানবাত্মার মিলনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। নাটকটির প্রধাণ চরিত্র অমল ব্যাধিতে শয্যাগত, সে ঘরের বন্ধণ ছিড়ে বাইরে বেড়িয়ে পরতে চায়, কিন্তু তা আর সম্ভব হয়না। শয্যাশায়ী অমলের সাথে ভিন গায়ের দইওয়ালা, ছেলের দল ও সুধার সাক্ষাৎ হয়। এসময় রাজার ‘ডাকঘর’ বসলে অমল ভাবে সকলের মত রাজা তার নামেও চিঠি পাঠাবে। এই কারনেই সে চিঠির প্রতীক্ষা করে। শেষ পর্যন্ত অমলের কাছে রাজার

ডাক আসে এবং সে ডাকে সারা দিয়ে সে সীমাকে ত্যাগ করে অসীমের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, আর মর্তে পড়ে থাকে তার স্মৃতি। এই নাটকের রাজা হলেন ঈশ্বর। ছেলের দল, দইওয়ালা, সুধারা হল মর্তজীবনের প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমলের মধ্য দিয়ে মানুষের চিরন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দেখিয়েছেন। তত্ত্বকথাকে বাদ দিলেও এই নাটক অপূর্ব কাব্যরস ও শিল্প কল্পনার এমন একস্তরে উঠেছে যে, যে কোন শিশুকেন্দ্রিক সাহিত্যে এর জুড়ি মেলা ভার।

প্রমথ চৌধুরীর সুযােগ্য সম্পাদনায় ‘সবুজপত্র পত্রিকা প্রকাশিত হলে সেই পত্রিকার পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের ‘ফাল্গুনী’ নাটকটি প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে প্রকৃতি আর মানুষকে একসাথে নিয়ে এসেছেন। জীবন ও মৃত্যু, শীত ও বসন্ত, জড়া ও যৌবণের দ্বৈত সত্তার পারস্পরিক সম্পর্কের পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ এখানে এক নতুন ঋতুনাট্যের পরিকল্পনা করেছেন। একদল তরুন চন্দ্রহাস যাদের নেতা, পণ করেছিল গুহার মধ্যে আত্মগােপনকারী জড়া বৃদ্ধকে ধরে নিয়ে আসবেন। বহু প্রয়াসের পর গুহার ভেতর থেকে যখন সেই বৃদ্ধকে ধরে নিয়ে এল, তখন দেখা গেল এত বৃদ্ধ নয়, জড়া নয়, শীত নয়, রিক্ততা নয়, এ হচ্ছে। তাদেরই সর্দার , যৌবণের প্রতীক, বসন্তের প্রতীক ও পূর্ণতার প্রতীক। বাইরে থেকে, দুর থেকে দেখলে যাকে জড়া-বৃদ্ধ বলে মনে হয় আসলে সে যে যৌবণের প্রতীক এই তত্ত্ব কথাটি ‘ফালুনী’ নাটকের মূল কথা।

এরপর রবীন্দ্রনাথের রূপক-সাংকেতিক নাটকগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ‘রক্তকরবী’ প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ভাবতেন আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা কখনােই মানব সভ্যতার স্থান নিতে পারেনা। এই নাটকে যন্ত্র | সভ্যতার সাথে কৃষি সভ্যতার বিরােধ দেখিয়ে এই তত্ত্বটির অবতাড়না করা হয়েছে। নাটকটির পটভূমি হল পাতালপুরি অর্থাৎ যক্ষপুরী। সেখান থেকে শ্রমিকেরা রাজার জন্য তাল তাল সােনা সংগ্রহ করে। এখানে আবির্ভাব ঘটে প্রাণশক্তির প্রতীক নন্দিনীর। নন্দিনীর সংস্পর্শে এসে রাজার মধ্যে আমূল পরিবর্তণ ঘটে। যখন রাজা জানতে পারেন তারই অগােচরে যৌবণের প্রতীক নন্দিনীর প্রেমিক রঞ্জন মারা গেছে তখন রাজা নিজেই তার জালের আবরণ ভেদ করে বাইরে এসে নিজের তৈরি ধৃজদ্বন্ড ভাঙতে যায়। এসময় তার বাধা হয়ে দারায় তার নিজেরই তৈরি সমাজ ব্যবস্থা। এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

যন্ত্রসভ্যতা যে মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহকে কখনাে আটকে রাখতে পারেনা রবীন্দ্রনাথ তার ‘মুক্তধারা’ নাটকে অভিজিৎ দ্বারা রাজা রণজিতের ইঞ্জিনিয়ার বিভূতি নির্মিত মুক্তধারাকে অবরুদ্ধ করার জন্য তৈরি বাধকে ভেঙে তা দেখিয়েছেন। মুক্তধারা’ রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত রূপক-সাংকেতিক নাটক।। | ‘কালের যাত্রা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন মহাকালের যাত্রা অর্থাৎ জীবন সত্তার বিকাশ তখনই ব্যহত হয় যখন সমাজের অপাঙতেয়, অচ্ছুৎগণ পঞ্চস্তরে ডুবে থাকে।

এভাবে রবীন্দ্রনাথ তার একের পর এক তত্ত্বমূলক রূপক-সাংকেতিক নাটকে তার নানা ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন। নাটকগুলিতে রবীন্দ্রনাথ মানবজীবনের চাওয়া পাওয়া গুলিকে, আধুনিক সভ্যতার বাস্তব রূপকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে এগুলি বিশ্বের যে কোন রূপক সাহিত্যের সমগােত্র হয়ে উঠেছে। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ আর ‘রক্তকরবী’ নাটক দু’টি অসাধারণ সৃষ্টি। এদের তুলনা বিশ্ব সাহিত্যে বিরল। অনেক সমালােচক রবীন্দ্রনাথের এই ধরণের নাটকগুলির সমালােচনা করে বলেন যে এগুলি কাব্যের জলাভূমি হয়ে উঠেছে। কিন্ত এই সমালােচনা মেনে নেওয়া যায়ন, কারন তত্ত্ব ও কাব্য সাহিত্যেরই অংশ। এগুলির মিশ্রণেই উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়। রবীন্দ্রনাথ তার রূপক-সাংকেতিক নাটকে এর যথার্থ সংমিশ্রণ ঘটাতে পেরেছিলেন জন্য নাটকগুলি কালজয়ী হয়ে উঠেছে। এখনও পাঠক-গবেষকরা তার রূপকসাংকেতিক নাটকগুলি পড়ে আপুত হন এবং নতুন নতুন তত্ত্ব খোজার চেষ্টা করেন। সাহিত্যিক হওয়ার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ যে একজন দার্শনিকও ছিলেন এই রূপক-সাংকেতিক নাটকগুলি তার প্রমাণ বহন করে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment