সামাজিক জীবনে মেলার প্রয়োজনীয়তা
ভূমিকা: মেলা’ কথাটির অর্থ মিলন। বিশেষ উপলক্ষে যেখানে অনেক মানুষের সমাগম ঘটে, নানা জিনিসপত্রের প্রদর্শনী হয়, তাকে মেলা বলা হয়। মেলার পিছনে কোনাে না কোনাে সামাজিক উৎসব, পূজা, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় প্রথা বা বিশ্বাস থাকে। স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছিলেন, “দিবে আর নিরে, মেলাবে মিলিবে।” সুতরাং সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে মেলা-র বিকল্প খুব কমই আছে।
মেলার উপলক্ষ্য : নানা উৎসব উপলক্ষ্যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল দুর্গোৎসব। দুর্গাপুজো শুধুমাত্র পুজো নয়, এটি এখন একটি জাঁকজমকপূর্ণ জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। দুর্গোৎসব ছাড়া রথযাত্রা, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, সরস্বতীপুজো প্রভৃতি উৎসবগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এইসব পুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা, প্রদর্শনী প্রভৃতিরও আয়ােজন হয়। মুসলমানদের উৎসবগুলির মধ্যে মহরম, ইদ, বকরি ইদ, সবেবরাত প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড়াে উৎসব হল বড়ােদিন। এ ছাড়া বৌদ্ধগণ বুদ্ধপূর্ণিমা, জৈনগণ পরেশনাথের জন্মদিন এবং বৈষুবগণ চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি সাড়ম্বরে পালন করেন। ধর্মোৎসবগুলির মধ্যে সামাজিকতার থেকে বড়াে হয়ে দেখা দেয় ধর্মীয় অনুরাগ।
সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব : সামাজিক ও পারিবারিক উৎসবগুলির মধ্যে জন্মদিন পালন, বিবাহ, নববর্ষ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, জামাইষষ্ঠী প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। এই উৎসবগুলি মূলত পারিবারিক, কিন্তু বহু মানুষের উপস্থিতির ফলে ওইগুলি মিলনােৎসবে পরিণত হয়। এ ছাড়া অম্বুবাচি’, ‘নবান্ন’, ‘পৌষসংক্রান্তি’ প্রভৃতি উৎসবগুলি মূলত কৃষিভিত্তিক। নববর্ষ, বৃক্ষরােপণ, বর্ষামঙ্গল, হলকর্ষণ, শারদোৎসব, বসন্তোৎসব প্রভৃতি ঋতু উৎসবেও মেলা বসে।
লৌকিক উৎসব : বাংলার উৎসবানুষ্ঠানে বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য দুই-ই বিদ্যমান। নিতান্ত স্থানীয় পরিবেশ, লৌকিক প্রয়ােজনে বা সমসাময়িক প্রভাবে বাংলার নিজস্ব উৎসবগুলির সৃষ্টি। চড়ক পূজা, গাজন উৎসব। শীতলা, সত্যনারায়ণ প্রভৃতি পুজো উপলক্ষ্যেও মেলা বসে। এগুলি একান্তভাবে গ্রামীণ মেলা।
উৎসবের আনন্দ : আমার আনন্দে সকলের আনন্দ হােক, আমার শুভে সকলের শুভ হােক, আমি যাহা পাই তাহা পাঁচজনের সহিত মিলিত হইয়া উপভােগ করি—এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ। তাই উৎসবের দিনটি ধনী-নির্ধন, জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের মিলনের, প্রীতি বিনিময়ের এবং ভাবের আদান-প্রদানের পবিত্র মুহূর্ত। মেলায় মিলনটাই বড়াে কথা। দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটাবার জন্য মেলার প্রয়ােজন অনেকখানি। মেলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব কম নয়। মেলায় ধর্ম, বর্ণ, ভাষার ভেদরেখা মুছে গিয়ে সবাই আনন্দে মেতে ওঠে।
উপসংহার : মেলা মানবজীবনে আরও বেশিমাত্রায় প্রকাশ পেলে মানুষের মনের প্রসার বাড়বে। যেসব উৎসব উপলক্ষ্যে মেলা বসে সেইসব উৎসবের সঙ্গে যে মেলা অনুষ্ঠিত হয় তা আরও সমৃদ্ধ করার দিকে মনােনিবেশ করা দরকার। তাই মেলাকে আকর্ষণীয় করে তােলার জন্য বিনােদনের উপকরণও সুসজ্জিত করার প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে। বর্তমানের স্বার্থসর্বস্ব সমাজে সবকিছু যেহেতু অর্থের মানদণ্ডে যাচাই করা হয়। তাই মেলার মানদণ্ডের সংস্কারের প্রয়ােজন দেখা দিয়েছে। সরকার। মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে অনেক সুযােগ-সুবিধা ও বিশেষ স্বীকৃতিও দিয়েছে। খাওয়াদাওয়া ও হস্তশিল্প কেন্দ্রিক মেলাও বর্তমানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মুখ্য আকর্ষণ হিসেবে রাজ্যের বিভিন্ন মন্ত্রীরা এইসব মেলার উদবােধন করে থাকেন। লােকসংস্কৃতির ধারক এই মেলা মানবজীবনকে আরও সমুন্নত ও সমৃদ্ধ করুক—এই কামনা আমাদের সকলের।
আরো পড়ুন
ছাত্রজীবনে শিষ্টাচারের উপযোগিতা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
রক্তদান জীবনদান – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
দেশ ভ্রমণের উপযোগিতা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
একটি গ্রামের আত্মকথা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।