সাম্রাজ্য বলতে কী বােঝায় ? মৌর্য ও ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্যের তুলনামূলক আলােচনা করো।

প্রশ্নঃ সাম্রাজ্য বলতে কী বােঝায় ? মৌর্য ও ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্যের তুলনামূলক আলােচনা করো। (৮ নম্বরের প্রশ্ন)

উত্তর:

ভূমিকাঃ “সাম্রাজ্য” শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Empire’। ইংরেজি ‘Empire’ শব্দটি লাতিন শব্দ ‘Imperium’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হল কর্তৃত্ব বা শক্তি । সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ঘটে রাজতন্ত্রকে কেন্দ্র করে।

সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা :  বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিকগণ ‘সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন। 

প্রচলিত সংজ্ঞা : (ক) যখন কোন ভূখন্ডের শাসক ‘সম্রাট’ উপাধি ধারণ করেন, তখন তাঁর অধীনস্থ রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্য বলা হয়। 

(খ) সাম্রাজ্য হল কোন শাসকের নেতৃত্বাধীন সেই ভৌগলিক অঞ্চল যেখানে শাসক সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করে রাষ্ট্রের সীমানার প্রসার ঘটায়। 

(গ) কোন শক্তিশালী রাজতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্রের অধীনস্থ সুবিশাল রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্য বলে।

রাজনৈতিক সংজ্ঞা : রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সাম্রাজ্য বলতে ভৌগােলিকভাবে বিস্তৃত বিভিন্ন রাজ্য ও জাতির সুসংবদ্ধ একককে বােঝায়, যেখানে শাসনকার্য পরিচালনা কবে সম্রাটসম্রাজ্ঞী অথবা ক্ষুদ্র একটি শাসকশ্রেণীর গােষ্ঠী।

অক্সফোর্ড ডিকশনারি এর সংজ্ঞা : শাসক ও শাসিতের ব্যবধানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে “The Oxford English Reference Dictionary সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন-“সাম্রাজ্য হল রাজনৈতিক ও সামরিক ভিত্তিতে গঠিত ভূখন্ডে সেই জনসমষ্টি যারা সংস্কৃতিগত ও জাতিগতভাবে শাসকগােষ্ঠী থেকে পৃথক”।

ভূমিকা : প্রাচীন ভারতে মগধকে কেন্দ্র করে মৌর্য সাম্রাজ্য এবং প্রাচীন গ্রিসে ম্যাসিডনকে কেন্দ্র কবে ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। এই দুটি সাম্রাজ্য ছিল প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শত্তি সাম্রাজ্য। এই দুটি সাম্রাজ্যের উত্থান ও বিকাশ প্রায় সমসাময়িক হলেও ঐতিহাসিক ও গবেষকরা দুটি সাম্রাজ্যের একাধিক সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য কবেছেন। এগুলি হল —

মৌর্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্যের সাদৃশ্য :

(১) সাম্রাজ্যের চরিত্র : মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশধরগণ এই সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসতেন বংশানুক্রমিক অধিকাবের উপর ভিত্তি করে ।

অন্যদিকে ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্য ছিল একটি বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র । অ্যামিনটাস-এর বংশধবেরা বংশানুক্রমিকভাবে ম্যাসিডনের সিংহাসনে বসতেন। যেমন অ্যামিনটাস- এর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ফিলিপ ও পৌত্র আলেকজান্ডার সিংহাসনে বসেন। 

(২) শাসন কাঠামাে : মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ভারতে একটি বিকেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলে সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সম্রাট। তিনি মন্ত্রিপরিষদ, অধ্যক্ষ, নগরাধ্যক্ষ এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের সাহায্য নিয়ে দেশ শাসন করতেন। রাজধানী পাটলিপুত্রের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য পৃথক গৌরবাের্ড ছিল।

অনুরূপভাবে ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ শাসক ছিলেন সম্রাট । তিনি ছিলেন একাধারে সাম্রাজ্যের প্রধান শাসক, বিচারক ও সেনাপতি। শরৎকাল ও বসন্তকালে সমস্ত নাগরিক ও সেনারা ‘জনপ্রিয় সভা’তে মিলিত হত। এই সভায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সম্রাট একটি পরিষদ তৈরি করত। এই পরিষদ সম্রাটকে শাসনকার্যে পরামর্শ দিত।

(৩) বিশালতা : উত্থানের প্রথম পর্যায়ে মৌর্য সাম্রাজ্য শুধুমাত্র মগধ-এ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে দ্রুত সম্রাজ্যবিজয় নীতির ফলে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে মৌর্য সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্যটি ইউরােপ, এশিয়া ও আফ্রিকার একটি বিরাট অংশ জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

(৪) সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরতা : মৌর্য সাম্রাজ্য ও ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে। এই দুই সাম্রাজ্যের প্রতি জনগণের কোন সমর্থন ছিল না।

(৫) শিল্পকলা : মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থাপত্য ও শিল্পকলার চমকপ্রদ উন্নতি ঘটে । সম্রাট অশােকের সময়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সৌধ, স্মৃতিস্তম্ভ ও কারুশিল্প কেন্দ্র নির্মিত হয়। সারনাথ, সাঁচী, কম্মিনদেই, নন্দনগড়- মৌর্য শিল্পকলার গৌরবময় উদাহরণ।

ম্যাসিডােনেও দ্বিতীয় ফিলিপের সময়ে ও পরবর্তীতে তৃতীয় আলেকজান্ডারের সময়ে একাধিক নগরীর পত্তন হয়েছিল । বহু অট্টালিকা, বিলাসবহুল ঘরবাড়ি, আলেকজান্দ্রিয়া শহরের শিল্পকলা আজও সমাদৃত হয়ে আছে। 

(৬) জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা : মৌর্য সাম্রাজ্যে সাহিত্য, ব্যাকরণ ও চিকিৎসাবিদ্যায় যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। চাণক্য, বৌধায়ন ও বশিষ্ঠ প্রমুখ জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন এই যুগের মানুষ। বারানসী, উজ্জয়িনী, তক্ষশীলা শিক্ষার কেন্দ্র রুপে মৌর্য যুগে খ্যাতি লাভ করে।

অন্যদিকে ম্যাসিডােনিয়া সাম্রাজ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বিশেষ উন্নতি ঘটে। রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়া ছিল জ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। অ্যারিস্টটল, টলেমি ও ইউক্লিডের মতো বিখ্যাত মানুষ এযুগে জন্মগ্রহণ করেন ।

মৌর্য ও ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্যের বৈসাদৃশ্য : মৌর্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্যের

সাদৃশ্য অপেক্ষা বৈসাদৃশ্যের পরিমাণ অনেক বেশি —

(১) অবস্থানগত : মৌর্য সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে অন্যদিকে ম্যাসিডােনিয়া সাম্রাজ্য ইউরােপ, এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে গড়ে উঠেছিল। 

(২) স্থায়িত্ব : মৌর্য সাম্রাজ্য টিকে ছিল 324 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 187 খ্রিস্টপূর্বাব্দ অর্থাৎ মাত্র 138 বছর। অন্যদিকে ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্য টিকেছিল 808 খ্রিস্টপূর্ব থেকে 146 খ্রিষ্টপূর্বাব্দ অর্থাৎ 662 বছর। তাই মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্যের চেয়ে অনেক কম ছিল। 

(৩) সাংস্কৃতিক পার্থক্য : মৌর্য যুগে ভারতে শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে। সম্পূর্ণ বিদেশি প্রভাবমুক্ত ছিল এই শিল্প-সংস্কৃতি ।

অন্যদিকে ম্যাসিডােনীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল গ্রিক ও প্রাচ্যের সংস্কৃতির সংমিশ্রণে। এই মিশ্র সংস্কৃতি হেলেনিস্টিক বা আলেকজান্দ্রীয় সংস্কৃতি নামে পরিচিত।

(৪) ধর্মীয় পার্থক্য : মৌর্য যুগে বিশেষত সম্রাট অশােকের উদ্যোগে বৌদ্ধধর্ম ভারতের সীমানা অতিক্রম কবে চিন, জাপান, সিংহল, সিরিয়া,মিশর, ম্যাসিডন প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে ম্যাসিডনের অধিবাসীরা একাধিক দেবদেবীর আরাধনা করলেও সম্রাটরা দেশের গন্ডির বাইরে ধর্ম প্রচারে কোন বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।

(৫) শিল্পকলার পার্থক্য : বিভিন্ন প্রকার চৈত্য, স্মৃতিসৌধ, শিলা-স্তম্ভ, লেখ প্রভৃতির অস্তিত্ব মৌর্য যুগে ছিল। বিশেষ করে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে মৌর্য রাতারা বিশেষভাবে যত্নশীল ছিলেন।

অন্যদিকে ম্যাসিডনবাসীর শিল্পচর্চা ভিন্নতর ছিল। সম্রাটরা রাজপ্রসাদ নির্মাণ, রাস্তা নির্মাণ প্রভৃতিতে ব্যস্ত ছিলেন । কিন্তু ম্যাসিডােনীয় শিল্পকলা ছিল মৌর্য যুগের শিল্পকলা অপেক্ষা গুণগত বিচারে নিম্নমানের।

(৬) মানবিকতা : সাম্রাজ্য পরিচালনায় মৌর্য সম্রাটরা যে উদারতা ও মানবিকতা দেখিয়েছেন তা ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্যের সম্রাটরা দেখাতে পারেননি। তাই সিংহসুলভ বিক্রম ম্যাসিডােনীয় সম্রাটদের থাকলেও মৌর্য সম্রাটদের মত ঋষিসুলভ উদারতা ও মানবিকতা ছিলনা। মৌর্য সম্রাটরা মানুষের হৃদয় জয় করেছেন আর ম্যাসিডােনীয় সম্রাটরা কেবল রাজ্যজয় করেছেন।

উপসংহার : সামগ্রিকভাবে বলা যায় বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে মৌর্য সাম্রাজ্যের মত ম্যাসিডন সাম্রাজ্যের অবদান অনেকখানি। দুটি সাম্রাজ্যের অবস্থানগত ও অন্যান্য একাধিক পার্থক্য থাকলেও নাগরিক পরিষেবা প্রদানে অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিল। যদিও ম্যাসিডনে দাসপ্রথার মতাে ঘৃণ্য একটি প্রথা বর্তমান ছিল। তবুও সম্রাজ্য গঠন ও পরিচালনার বিষয়ে ম্যাসিডন ছিল পারদর্শী।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment