সংস্কৃতায়ন (Sanskritization) বলতে কী বােঝায়? ধারণাটির পর্যালােচনা কর। ৩+৫ Class 12 | Sociology (ভারতীয় সমাজ) 8 Marks
উত্তর:
অধ্যাপক শ্রীনিবাস ১৯৫২ সালে প্রকাশিত Religion and society among the Coorgs of Southern India শীর্ষক গ্রন্থে সর্বপ্রথম সংস্কৃতায়ন শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি সাধারণভাবে সামাজিক গতিশীলতার এবং বিশেষত নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যেকার সামাজিক গতিশীলতা ব্যাখ্যার ব্যাপারে সংস্কৃতায়নের প্রক্রিয়াটির উপর গুরুত্ব আরােপ করেন।
“সংস্কৃতায়ন” কথাটি বােঝাতে গিয়ে শ্রীনিবাস বুঝিয়েছেন যে, অনেক ক্ষেত্রে ‘নীচু জাতের মানুষ সামাজিক স্তরবিন্যাসের উচ্চপর্যায়ে অবস্থিত ‘উঁচু’জাতের পেশা, জীবনধারা প্রভৃতি অনুকরণের মাধ্যমে উন্নত স্তরে উন্নীত হতে প্রয়াসী হয়। সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে এই প্রচেষ্টাকে শ্রীনিবাস “সংস্কৃতায়ন” বলে অভিহিত করেছেন। সুতরাং তার ব্যাখ্যা অনুসারে যে উপায় বা পদ্ধতিতে একটি নিম্নস্তরের হিন্দু জাতি, উপজাতি বা অন্য কোন গােষ্ঠী, কোন উচ্চজাতি বা দ্বিজাতির অনুসরণে নিজস্ব রীতিনীতি, প্রথা, আদর্শবােধ, জীবনযাত্রা প্রণালী পরিবর্তন করে তাকে সংস্কৃতায়ন বলা হয়।
সংস্কৃতায়ন হল একটি অনুকরণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় নিচুজাতের মানুষজন উঁচুজাতের বা ব্রাত্মণদের ধ্যান-ধারণা,বিশ্বাস, মূল্যবােধ, রীতিনীতি, জীবনধারা, আচারানুষ্ঠান প্রভৃতি অন্ধভাবে অনুসরণ-অনুকরণ করে।
শ্রীনিবাস তাঁর সংস্কৃতায়নের ধারণাকে ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত করেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে সংস্কৃতায়নের ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, এ হল একটি সামাজিক সচলতার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নীচুজাত নিরামিষভােজন অনুসরণ ও আসবপান (সুরাপান) পুরােপুরি পরিহার করে দু’এক পুরুষের মধ্যে সামাজিক স্তরবিন্যাসে উচ্চতর অবস্থান অর্জন করে। তারপর ব্রাত্মণের জীবনধারা অনুসরণ করাকেই সংস্কৃতায়ন।
প্রক্রিয়া হিসাবে প্রতিপন্ন করেন। আগে শ্রীনিবাস, সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র খাদ্যভাস, আচার-অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় আচরণ অনুসরণের কথা বলেছেন। পরবর্তীকালে কিন্তু তিনি কর্ম-ধর্ম, পাপ-পুণ্য-মােক্ষ প্রভৃতি আদর্শসমূহ অনুসরণের উপরও জোর দেন।
পর্যালােচনা : তিনি অনুধাবন করেন যে বর্ণ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত নীচুজাতির মানুষ নিম্নমর্যাদা লাভ করে। তারা উচ্চ সামাজিক মর্যাদা অর্জনের আশায় ব্রাত্মণ ও ক্ষত্রিয় প্রভৃতি উচ্চবর্ণের জীবনপ্রণালী অনুসরণ করে। এইভাবে নিম্নবর্গের আদিবাসীরা নিরামিষাশী হয়। ব্রাত্মণদের মত তারা আমিষ আহার পরিহার এবং পৈতা পরিধান করে। নিজেদের দেবদেবীর পরিবর্তে তারা পৌরাণিক দেবদেবীর পূজা করে। মাদক পানীয় পরিহার করে। তাদের মধ্যে এই প্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত হয় যে ব্রাত্মণদের জীবনরীতি অনুসরণ করলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।
প্রথম দিকে অধ্যাপক শ্রীনিবাস সংস্কৃতায়নকে ব্রাত্মণায়নের অনুরূপ হিসাবে পর্যালােচনা করলেও পরবর্তীকালে তা সংশােধন করেন । তিনি লক্ষ্য করেন যে, এই প্রক্রিয়ায় ব্রাত্মণ ছাড়াও নির্দেশক গােষ্ঠী (Reference Group) হিসাবে অন্যান্য প্রভাবশালী গােষ্ঠীর গুরুত্বও কম নয়। তাঁর মতে দক্ষিণভারতে ব্রাত্মণের আদর্শ, উত্তরে ক্ষত্রিয় আদর্শ, পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বৈশ্য আদর্শ “নীচু জাতির পক্ষে অনুকরণীয় বলে মনে করা হয়। তিনি এও লক্ষ্য করেছেন যে, উচ্চবর্ণযুক্ত না হয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্দিষ্ট পেশাজীবি জনসমষ্টি অর্থনৈতিক ক্ষমতার জোরে এক একটি অঞ্চলে আধিপত্যকারী জাতিতে (Dominant Caste) পরিণত হয়েছে। আধিপত্যকারী জাতি ও সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়ার যৌথ প্রভাবে সনাতন জাতিপ্রথার অচলাবস্থা ভেঙ্গে গিয়ে ভারতীয় জাতিপ্রথায় সামাজিক সচলতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি তার Mobility in Caste System গ্রন্থে দাবী করেছেন।
প্রতিপত্তিশালী জাত ও সংস্কৃতায়ন : শ্রীনিবাস উল্লেখ করেন যে, সংস্কৃতায়নের ক্ষেত্রে কোন জাতি কোন জাতিকে অনুকরণ করে তা ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ জাতির আঞ্চলিক প্রাধান্য প্রতিপত্তির উপর নির্ভর করে। কোন নিম্নবর্ণের জাতি আলিক বিচারে প্রভাবশালী হলে, সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী নিচু জাতির আচার-আচরণ উচ্চবর্ণের জাতিগুলি অনুসরণ করে। উদাহরণস্বরূপ তিনি উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যালঘুদের উপর জাঠ, রাজপুত প্রভৃতি জাতির জীবনধারাগত বৈশিষ্ট্য ব্রাত্মণরাও অনুকরণ করে। তারা ব্রাত্মণদেরকে কর্মচারী হিসাবেও নিয়ােগ করে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় সদগােপ জাতের প্রভাব-প্রতিপত্তি অধিক।
সংস্কৃতায়নের গতিবৃদ্ধির সহায়ক উপাদান : সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়ার প্রসার ও গতি কতকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে গতিশীল অর্থনীতির বিকাশ, শিল্পায়ন, পরিবহণ ও যােগযােগ ব্যবস্থার উন্নতি, ধর্মনিরপেক্ষ আইনব্যবস্থা, সাক্ষরতা ও শিক্ষার প্রসার, পশ্চিমী প্রযুক্তি প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। গণমাধ্যমগুলিও সংস্কৃতায়নের ধারণা ও মূল্যবােধের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এ বেতার, দুরদর্শন, পত্র-পত্রিকা প্রভৃতির মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে সংস্কৃতায়নমুখী প্রবণতা প্রসারিত হচ্ছে।
সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়া কেবলমাত্র চতুর্বণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই প্রবণতা আদিবাসীদের মধ্যেও সম্প্রসারিত হয়েছে। যেমন সাঁওতাল, ওঁরাও প্রভৃতি উপজাতিদের মধ্যে এই প্রক্রিয়া যথেষ্ট সজাগ। প্রসঙ্গত আন্দ্রে বেঁতেই (Andre Betei)-এর ছােটনাগপুরের ওঁরাওদের ভগত আন্দোলনের কথা উল্লেখ্য। সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংস্কৃতায়ন হল একটি শক্তিশালী উপাদান যার ফলে সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরনের সামাজিক সচলতার সৃষ্টি হয়।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।
আমি এটা পড়ে খুবই উপকৃত হলাম