শব্দালঙ্কার কাকে বলে ? শব্দালঙ্কারের শ্রেণিবিভাগ গুলির পরিচয় দাও।
উত্তর:
শব্দালংকার:
শব্দের ধ্বনিরূপকে আশ্রয় করে যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় শব্দালংকার অর্থাৎ শব্দকে ঘিরে এ অলংকারের সৃষ্টি। এর মূল সৌন্দর্য টুকু ফুটে উঠে শব্দের ধ্বনিরূপে। মনে রাখতে হবে শব্দালংকারের অলংকার নির্ভর করে শব্দের ওপর। তাই ইচ্ছে মতো তাকে বদলে দেয়া যায় না।
শব্দালংকারের শ্রেণিবিভাগ :
শব্দালংকার পাঁচ প্রকার। যথা –
১) অনুপ্রাস, ২) শ্লেষ, ৩) যমক, ৪) বক্রোক্তি, ৫) পুনরুক্তবদাভাস
১) অনুপ্রাস:
অনু শব্দের অর্থ পরে বা পিছনে আর প্রাস শব্দের অর্থ বিন্যাস, প্রয়োগ বা নিক্ষেপ। একই বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যুক্তভাবে হোক বা বিযুক্তভাবে হোক একাধিকবার উচ্চারিত হয়ে যদি কবিতায় ধ্বনি মাধুর্যের সৃষ্টি করে তবে তাকে অনুপ্রাস অলংকার বলে ।
এর মূল বৈশিষ্ট্য গুলো হল:
ক) এতে একই ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছ একাধিক বার ব্যবহৃত হবে।
খ) একাধিক বার ব্যবহৃত ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছ যুক্ত শব্দগুলো যথাসম্ভব পরপর বা কাছাকাছি বসবে।
গ) এর ফলে সৃষ্টি হবে একটি সুন্দর ধ্বনি সৌন্দর্যের।
উদাহরণ :
কুলায় কাঁপিছে কাতর কপোত দাদুরি ডাকিছে সঘনে
“গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি
গরজে গগনে গগনে,
গরজে গগনে।” …(রবীন্দ্রনাথ)
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘ক’ এবং ‘গ’ এই ব্যঞ্জনধ্বনিটি কবিতার মধ্যে বারংবার উচ্চারিত হওয়ার ফলে কবিতায় এমন এক ধ্বনি মাধুর্যের সৃষ্টি হয়েছে, যাতে মনে হয় পংক্তি গুলির ভেতর থেকে মেঘের ডাক ধ্বনিত হয়ে উঠছে। একই ব্যঞ্জনের পুনঃপুনঃ উচ্চারণের ফলে কবিতায় এই ধ্বনি সৌকর্য সৃষ্টি হয়েছে বলে এটি অনুপ্রাস অলংকার ।
অনুপ্রাসের শ্রেণিবিভাগ :
অনুপ্রাস অলংকার ছয় প্রকার। যথা –
ক) অন্ত্যানুপ্রাস
খ) শ্রুত্যনুপ্রাস
গ) সর্বানুপ্রাস
ঘ) ছেকানুপ্রাস
ঙ) বৃত্ত্যনুপ্রাস
চ) লাটানুপ্রাস
ক) অন্ত্যানুপ্রাস: কবিতার এক চরণের শেষে যে শব্দধ্বনি থাকে অন্য চরণের শেষে তারই পুনরাবৃত্তির যে অনুপ্রাস অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম অন্ত্যানুপ্রাস। অর্থাৎ কবিতার দু’টি চরণের শেষে যে শব্দধ্বনির মিল থাকে তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে। একে অন্ত্যমিলও বলা হয়ে থাকে। পদান্তের সাথে পদান্তের বা চরণান্তের সাথে চরণান্তের যে ছন্দমিল তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে।
উদাহরণ :-
১. এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন ভরসা।
২. দিনের আলো নিভে এলো সূর্যি ডোবে ডোবে,
আকাশ ঘিরে মেঘ টুটেছে ছাঁদের লোভে লোভে।
৩. রাখাল গোরুর পাল লয়ে যায় মাঠে
শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।
এখানে ১নং উদাহরণে ‘বরষা’ ও ‘ভরসা’ ; ২নং উদাহরণে ‘ডোবে’ আর ‘লোভে’ এবং ৩নং উদাহরণে ‘মাঠে’ আর ‘পাঠে’ র অন্ত্যমিল তাই এটি অন্ত্যানুপ্রাস অলংকার।
আরও কিছু উদাহরণ :
৪. “রক্তমাখা অস্ত্রহাতে যত রক্ত আঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।”
৫. “গগনে ছড়ায়ে এলোচুল
চরণে জড়ায়ে বনফুল।”
৬. “আসে গুটি গুটি বৈয়াকরণ
ধূলিভরা দুটি লইয়া চরণ।”
খ) শ্রুত্যনুপ্রাস: বাগযন্ত্রের একই স্থান থেকে উচ্চারিত শ্রতিগ্রাহ্য , সাদৃশ্যময় ব্যঞ্জনবর্ণের অনুপ্রাসকে শ্রুত্যনুপ্রাস অলংকার বলে।
উদাহরণ :-
১. বাতাস বহে বেগে
ঝিলিক মারে মেঘে।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘বেগে’ শব্দের ‘গ’ এবং ‘মেঘে’ শব্দের ‘ঘ’ যদিও একই বর্ণ নয় তবুও এরা বাগযন্ত্রের একই স্থান (কণ্ঠ) থেকে উচ্চারিত হয়েছে বলে এটি শ্রুত্যনুপ্রাস অলংকার।
২. কালো চোখে আলো নাচে
আমার যেমন আছে।
গ) সর্বানুপ্রাস: সমগ্র চরণের সঙ্গে সমগ্র চরণের যে ধ্বনি সাম্য ঘটে তাকে সর্বানুপ্রাস অলংকার বলে।
উদাহরণ :-
সন্ধ্যা মুখের সৌরভী ভাষা
বন্ধ্যা বুকের গৌরবী আশা।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে প্রথম চরণের সঙ্গে দ্বিতীয় চরণের শব্দ বা শব্দাংশ গুলির ধ্বনি সাম্য ঘটেছে বলে এটি সর্বানুপ্রাস অলংকার ।
ঘ) ছেকানুপ্রাস: দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে একইক্রমে মাত্র দু’বার ধ্বনিত হলে যে অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম ছেকানুপ্রাস।
উদাহরণ :- ১. এখনি অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘ন’ এবং ‘ধ’ এই দুটি ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্তভাবে (ন্ধ) ক্রমানুসারে (ন, ধ) মাত্র দুবার (অন্ধ, বন্ধ) উচ্চারিত হয়েছে বলে এটি ছেকানুপ্রাস অলংকার ।
২. করিয়াছ পান চুম্বন ভরা সরস বিম্বাধরে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
– এখানে যুক্ত ব্যঞ্জন ‘ম্ব’ একের অধিকবার ক্রমানুসারে ধ্বনিত হয়েছে চুম্বন ও বিম্বাধরে এর মধ্যে, তাই এটি ছেকানুপ্রাস অলংকার।
আরো কিছু উদাহরণ:
৩. অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে ?
৪. নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে ভেবেছিলাম গাইব না গান (নজরুল)
৫. জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে।
ঙ) বৃত্ত্যনুপ্রাস: একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে, বর্ণগুচ্ছ স্বরূপ অথবা ক্রম অনুসারে যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে বহুবার ধ্বনিত হলে যে অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় বৃত্ত্যনুপ্রাস।
উদাহরণ :-
১. সাগর জলে সিনান করি সজল এলোচুলে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
– এখানে একক ব্যঞ্জন ‘স’ পরপর তিনবার ও ‘ল’ পরপর চারবার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় এটি অলঙ্কার বৃত্ত্যনুপ্রাস।
২. কেতকী কত কী কথা কহে কামিনীর কানে কানে।
চ) লাটানুপ্রাস: যে অনুপ্রাস অলংকারে একই শব্দ দুবার বা তার বেশি একই অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং ধ্বনি সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে, তখন সেই অনুপ্রাসকে লাটানুপ্রাস বলে।
উদাহরণ :-
১. গাছে গাছে ফুল ফুলে ফুলে অলি সুন্দর ধরাতল।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘গাছে’ এবং ‘ফুলে’ শব্দ দুটি দুবার একই অর্থে ব্যবহৃত হওয়ায় দুটি ক্ষেত্রেই লাটানুপ্রাস অলংকার হয়েছে ।
অনুপ্রাস অলংকারের আরও কিছু উদাহরণ :
১. ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিশ্বাসি
২. যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া, খুঁজে ফিরি সারা দেশটা
৩. একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু
৪. কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া সজল চক্ষে, করুন রক্ষে গরিবের ভিটাখানি।
৫. মধু মাসে মলয় মারুত মন্দ মন্দ মালতীর মধুকর পিয়ে মকরন্দ।
৬. নন্দপুর চন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার।
৭. কত না ছিন্ন চরণচিহ্ন ছড়ানো সে ঠাঁই ঘিরে।
৮. ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা শঙ্কা নাহিক আর।
৯. আবাদ করে বিবাদ করে সুবাদ করে তারা।
১০. চলচপলার চকিত চমকে করিছে চরণ বিচরণ।
১১. এত ভঙ্গ বঙ্গ দেশ তবু রঙ্গে ভরা।
১২. ভৃত্য নিত্য ধুলা ঝাড়ে যত্ন পুরামাত্রা।
১৩. ছুটির সঙ্গে রুটির ব্যবস্থা হলে দুটিই পরিপাটী হয়।
১৪. বিরূপ শ্রীরূপে কহিলেন চুপে।
১৫. পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়।
২) শ্লেষ:
একটি শব্দ একাধিক অর্থে একবার মাত্র ব্যবহারের ফলে যে অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম শ্লেষ। এতে একবার মাত্রই শব্দটি ব্যবহৃত হয় কিন্তু তাতে ভিন্ন অর্থের ব্যঞ্জনা থাকে। এই শ্লেষ শব্দকেন্দ্রিক বলে কেউ কেউ একে শব্দ-শ্লেষ বলেন।
উদাহরণ :
১. আছিলাম একাকিনী বসিয়া কাননে
আনিলা তোমার স্বামী বান্ধি নিজ গুণে। (মুকুন্দরাম)
– এখানে ‘গুণে’ শব্দে শ্লেষ অলংকার ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি অর্থ ধনুকের ছিলায় আর অন্য অর্থ সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা গুণ।
আরও কিছু উদাহরণ:
২. মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে (নজরুল)
এখানে কবি ‘রবি’ বলতে সূর্য ও রবীন্দ্রনাথকে বুঝিয়েছেন।
৩. শ্রীচরণেষু
‘শ্রীচরণেষু’ একটা জুতোর দোকানের নাম। ক্রেতার ‘শ্রীচরণ ভরসা করে জুতোর দোকানদারকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে হয়, তাই শ্রীচরণ শব্দের শেষে সপ্তমীর বহুচবন যুক্ত করে ‘শ্রীচরণেষু’ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু শব্দটা ভাঙলে আরো গভীর তাৎপর্য উদ্ঘাটিত হয়- অর্থাৎ ‘শ্রীচরণে ‘ষু’(shoe বা জুতো পরার আহ্বান), যা শব্দ ভাঙায় পাওয়া গেল।
শ্রেণিবিভাগ : শ্লেষ অলংকারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন: অভঙ্গ শ্লেষ ও সভঙ্গ শ্লেষ।
ক) অভঙ্গ শ্লেষ: শব্দকে না ভেঙ্গে অখণ্ড অবস্থায় রেখেই যে শ্লেষ প্রকাশ পায় তা-ই অভঙ্গ শ্লেষ।
উদাহরণ :- ১. আনিলা তোমার স্বামী বান্ধি নিজ গুণে।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে শ্লেষাত্মক শব্দ হল ‘গুনে’ । ‘গুনে’ শব্দের প্রথম অর্থ ধনুকের ছিলা এবং দ্বিতীয় অর্থ উৎকর্ষতা । শ্লেষাত্মক শব্দটিকে না ভেঙে একাধিক অর্থ পাওয়া যাচ্ছে বলে এটি অভঙ্গ শ্লেষ অলংকার ।
২ . মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে। শ্লেষাত্মক শব্দ ‘মধু’।একটি অর্থ honey, অন্যটি কবি মধুসূদন।
খ) সভঙ্গ শ্লেষ: অখণ্ড অবস্থায় শব্দের শ্লেষ প্রকাশ না পেয়ে শব্দকে ভাঙলে যে শ্লেষ প্রকাশ পায় তার নাম সভঙ্গ শ্লেষ। একাধিক অর্থ পাওয়ার জন্য শ্লেষাত্মক শব্দটিকে ভাঙতে হয়।
উদাহরণ :-
১. আমার দিনের শেষ ছায়াটুকু মিলাইলে
মূলতানে গুঞ্জন তার রবে চিরদিন ।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে শ্লেষাত্মক শব্দ হল ‘মূলতান’।মূলতান কথাটির প্রথম অর্থ একটি রাগিনীর নাম।দ্বিতীয় অর্থ মূল+তান অর্থাৎ প্রধান সুর।একাধিক অর্থ পাওয়ার জন্য শ্লেষাত্মক শব্দটিকে ভাঙতে হচ্ছে বলে এটি সভঙ্গ শ্লেষ অলংকার।
২. এল না এল না সে মাধব।
মাধব=কৃষ্ণ , মাধব(মা+ধব)=স্বামী।
৩) যমক:
একই শব্দ একই স্বরধ্বনিসমেত একই ক্রমে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে একাধিক বার ব্যবহারের ফলে যে অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম যমক। যমক শব্দের অর্থ হল যুগ্ম বা দুই। লক্ষনীয় যে, একই শব্দ দুই বা ততোধিক বার ব্যবহৃত হওয়া এবং ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করা এর বৈশিষ্ট্য।
উদাহরণ :
১. মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
– এখানে ‘মাটি’ একটি শব্দ যা দুইবার ব্যবহৃত কিন্তু অর্থ ভিন্ন। প্রথম মাটি ধূলা অর্থে এবং দ্বিতীয় মাটি বিনষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
২. ওরে ও তরুন ঈশান
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদি। (নজরুল)
৩. তোমার এ বিধি, বিধি, কে পারে বুঝিতে (মধুসূদন )
যমকের শ্রেণিবিভাগ: যমকের আবার দু-প্রকারের শ্রেণীবিভাগ করা যেতে পারে। যেমন- সাধারণ শ্রেণিবিভাগ ও যমকের প্রধান শ্রেণিবিভাগ।
যমকের সাধারণ শ্রেণিবিভাগ: সাধারণভাবে যমক চার প্রকার। যথা– ক) আদ্য যমক খ) মধ্য যমক গ) অন্ত্য যমক ঘ) সর্বযমক।
ক) আদ্য যমক :
যে যমক অলংকারে যমক শব্দ গুলি চরণের শুরুতে থাকে তাকে আদ্য যমক অলংকার বলে।
উদাহরণ :-
১. ঘন ঘনাকারে ধূলা উঠিল আকাশে। (মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
২. ভারত ভারত খ্যাত আপনার গুণে।
খ) মধ্য যমক: যে যমক অলংকারে যমক শব্দ গুলি চরণের মধ্যে অবস্থান করে তাকে মধ্য যমক বলে।
উদাহরণ :- নামজাদা লেখকদেরও বই বাজারে কাটে, কাটে বেশি পোকায়। (প্রমথ চৌধুরী)
গ) অন্ত্য যমক: যে যমক অলংকারে চরণের শেষে যমক শব্দ গুলি থাকে তাকে অন্ত্যযমক অলংকার বলে।
উদাহরণ :-
১. দুহিতা আনিয়া যদি না দেহ
নিশ্চয় আমি ত্যাজিব দেহ। (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
ঘ) সর্বযমক: যে যমক অলংকারে যমক শব্দ গুলি চরণের সমগ্র চরণ জুড়ে থাকে তাকে সর্বযমক অলংকার বলে ।
উদাহরণ :-
কান্তার আমোদপূর্ণ কান্ত-সহকারে।
কান্তার আমোদপূর্ণ কান্ত-সহকারে।।
যমকের প্রধান শ্রেণিবিভাগ: সার্থক যমক ও নিরর্থক যমক অলংকার ।
ক) সার্থক যমক অলংকার: যে যমক অলংকারে যমক শব্দ দুটির প্রতিটিই অর্থপূর্ণ তাকে সার্থক যমক অলংকার বলে ।
উদাহরণ :- ১. রক্ত মাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত আঁখি
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে যমক শব্দ হল ‘রক্ত’ । প্রথম রক্ত শব্দের অর্থ শোণিত (blood) এবং দ্বিতীয় রক্ত শব্দের অর্থ রাগান্বিত।এখানে যমক শব্দ দুটির প্রতিটি অর্থপূর্ণ বলে এটি সার্থক যমক অলংকার।
২. মশাই দেশান্তরী করলে আমায় কেশনগরের মশায়।
৩. ঘন বন তলে এসো ঘন নীল বসনা।
খ) নিরর্থক যমক অলংকার: যে যমক অলংকারে যমক শব্দ দুটির একটি অর্থপূর্ণ ও অন্যটি অর্থহীন তাতাকে নিরর্থক যমক অলংকার বলে ।
উদাহরণ :-
১. শেফালি রায়ের সঙ্গে আমার
একফালিও পরিচয় নেই।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে যমক শব্দ বা শব্দাংশ হল ‘ফালি’।এখানে প্রথম ফালি শব্দের কোনো অর্থ নেই কারণ তা শেফালি শব্দের অন্তর্গত একটি শব্দাংশ মাত্র। কিন্তু দ্বিতীয় ফালি শব্দটি অর্থপূর্ণ যার অর্থ টুকরো। কাজেই যমক শব্দ দুটির একটি অর্থহীন এবং একটি অর্থপূর্ণ বলে এটি নিরর্থক যমক অলংকার ।
২. মাসীমার সীমাতেও আমি আসিনি।
৩. তারার যৌবন বন ঋতুরাজ তুমি।
৪. যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।
৪) বক্রোক্তি:
বক্রোক্তি কথার অর্থ বাঁকা কথা।
সোজাসুজি কোন কথা না বলে প্রশ্ন বা স্বরবিকৃতির দ্বারা বাঁকা ভাবে বলায় যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম বক্রোক্তি। বক্তা তাঁর বক্তব্যে কি কথা কি ভাবে বলতে চান তা সঠিক ভাবে জেনেও শ্রোতা অনেক সময় ইচ্ছে করে তাকে একটু বাঁকিয়ে ও ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করলে তা বক্রোক্তি অলঙ্কার হয়।
উদাহরণ:
আপনার কি পানাভ্যাস আছে?
আজ্ঞে না, পকেটের পজিশন খারাপ কিনা- তাই এখনও রপ্ত করে উঠতে পারি নাই।
– এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বক্তার জিজ্ঞাসার জবাবে শ্রোতা একটু ঘুরিয়ে বাঁকা ভাবে তার উত্তর দিয়েছেন, তাই অলঙ্কার এখানে বক্রোক্তি।
আরও কিছু উদাহরণ:
দেখি, দে-তো, এই কথাটার উত্তর দে দেখি
– তোরা দক্ষিনের লোক,উত্তরের কী জানিস?
বক্তা বুঝিয়েছে প্রশ্নের উত্তর, আর শ্রোতা বুঝেছেন উত্তর দিকের কথা।
অশ্বত্থের শাখা করে নি কি প্রতিবাদ? (জীবনানন্দ)
‘কে বলে কাব্যের ফুকে এ-পৃথিবী নিরাময় হয়, হতে পারে’ (শামসুর রাহমান)
শ্রেণিবিভাগ :
বক্রোক্তি দুই প্রকারের। শ্লেষবক্রোক্তি ও কাকু-বক্রোক্তি। উদাহরণের প্রথমটি শ্লেষবক্রোক্তি এবং দ্বিতীয়টি কাকু-বক্রোক্তি।
ক) শ্লেষ বক্রোক্তি : একই শব্দে নানা অর্থ গ্রহণ করে উক্তি প্রত্যুক্তির মাধ্যমে যে বক্রোক্তি অলংকার হয় তাকে শ্লেষ বক্রোক্তি অলংকার বলে ।
উদাহরণ :-
বক্তা : আপনার কপালে রাজদণ্ড আছে।
শ্রোতা : নিশ্চয়, আইন অমান্য করে ছ’মাস খেটেছি এখন সশস্ত্র বিপ্লবে না হয় বছর কত খাটবো।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে বক্তার উক্তির মধ্যে ‘রাজদণ্ড’ কথাটি শ্লেষাত্মক।যার দুটি অর্থ হলো- ক) রাজার শাসনদণ্ড হাতে পাওয়া বা রাজা হওয়া।খ) রাজশাস্তি বা গুরুতর শাশাস্তি।বক্তা এখানে প্রথম আলো অর্থ ধরে নিয়ে বক্তব্য রাখলেও শ্রোতা দ্বিতীয় অর্থটি ধরে নিয়ে উত্তর দিয়েছে।তাই এটি শ্লেষ বক্রোক্তি অলংকার ।
খ) কাকু বক্রোক্তি : কাকু মানে স্বরভঙ্গি।কন্ঠধ্বনির বিশেষ ভঙ্গির ফলে বিধিমূলক বাক্য নিষেধমূলক বাক্যে কিংবা নিষেধমূলক বাক্য বিধিমূলক বাক্যে যদি পর্যবসিত হয় তবে কাকু বক্রোক্তি অলংকার বলে।
উদাহরণ :- স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চাইহে কে বাঁচিতে চাই
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।