শিক্ষাক্ষেত্রে রাজা রামমােহন রায়ের অবদান সংক্ষিপ্তভাবে আলােচনা করাে।
অথবা, ভারতবর্ষে রামমােহন রায় আধুনিক শিক্ষার অগ্রদূত।’—উক্তিটি পর্যালােচনা করাে।
উত্তর :
শিক্ষাক্ষেত্রে রাজা রামমােহন রায়ের অবদান :
রামমােহন রায় প্রথম ভারতীয়, যিনি সমাজের কুসংস্কারগুলি বিশ্লেষণ করে আধুনিক ভারতের নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। তার ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কার—সর্বোপরি শিক্ষা-সংক্রান্ত সংস্কার ভারতবাসীর মধ্যে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। সামাজিক অন্যায় ও অবিচার বিরুদ্ধে তিনি গর্জে ওঠেন। দেশবাসীকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তােলার ব্যাপারে তিনিই পথিকৃৎ। তাই তিনি আধুনিক ভারতের জনক, ভারতপথিক, নবজাগরণের অগ্রদূত।
[1] শিক্ষা ভাবনায় আধুনিক দৃষ্টিভঙি : রামমােহনের শিক্ষণ চিন্তা ও সংস্কারমূলক ভাবনা আধুনিক যুগের শিক্ষার সঙ্গে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভারতীয় শিক্ষার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব উপলব্ধি করে তিনি তা পরিবর্তনের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তিনি বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন— বৈজ্ঞানিক চিন্তাভিত্তিক শিক্ষা ভারতীয় সমাজ থেকে কুসংস্কারমুক্ত করে নতুন ভারতের পথ দেখাতে পারবে। তিনিই প্রথম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।
[2] দেশীয় শিক্ষা, ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নতিসাধন ও প্রসার : তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার যেমন প্রয়ােজন অনুভব করেছিলেন, তেমনি দেশীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্কারের মাধ্যমে উন্নতিসাধনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি 1823 খ্রিস্টাব্দে লর্ড আমহার্স্ট সাহেবকে সংস্কৃত ভাষার কাঠিন্য ও আপামর ভারতবাসীর দুর্বোধ্যতা সম্পর্কে অবগত করেছিলেন এবং তিনি প্রাচ্য শিক্ষার আধুনিকভাবে প্রসারের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় সংস্কৃতি, সাহিত্য, ভাষা, ঐতিহ্যকে পাশ্চাত্যবাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে প্রথম ভারতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতির দূত।
[3] শিক্ষাদানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ভাবনা : ভারতীয় জনগণকে উন্নতির জন্য আরবি, ফারসি, সংস্কৃত শুধু নয় ইংরেজি ও বিজ্ঞানচর্চা করা জরুরি তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, দর্শন প্রভৃতি আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে ভারতবাসীকে আধুনিকমনস্ক করে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি বিদ্যা শিক্ষার জন্য বিজ্ঞান, গণিত, রসায়নশাস্ত্র, জ্যামিতি, যন্ত্রবিজ্ঞান প্রভৃতির ওপর প্রাধান্য প্রদান করেছিলেন। তিনি ভারতীয়দের পরাবিদ্যার চর্চা অহেতুক ভাবতেন।
[4] বাংলা গদ্যসাহিত্যের ভাবনা ও উন্নয়ন : বাংলা গদ্যগুলি যা ছিল তার অধিকাংশ ছিল সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য। যা সাধারণ ভারতবাসীর কাছে ছিল দুর্বোধ্য। তিনি বাংলা ভাষায় শাস্ত্রবিচার, ধর্ম-বিষয়ক পুস্তক, ব্যাকরণ প্রভৃতি সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর প্রথম গদ্যগ্রন্থ বেদান্ত গ্রন্থ’ 1815 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। এ ছাড়া গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ নামে 1833 খ্রিস্টাব্দে ব্যাকরণ বই রচনা করেছিলেন। তিনি গদ্যসাহিত্যকে আরও প্রাঞ্জল করে তুলেছিলেন। তাঁর লেখনীতে যুক্তিতর্ক, বিশ্লেষণী ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়।
[5] সংবাদমাধ্যম ও পত্রিকার সাহায্যে শিক্ষার বিস্তার : জনমত গঠন, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূরীকরণে তিনি সংবাদ মাধ্যম ও পত্রিকাকে হাতিয়ার করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযােগ্য প্রকাশনা হল— সম্বাদ কৌমুদি, মিরাৎ-উল-আখবার, The Brahmanical Magazine। তৎকালীন সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা-বিষয়ক প্রবন্ধ। লােকহিতসাধনে প্রভূত কার্যকারী ছিল।
[6] শিক্ষাবিস্তারের জন্য সাহিত্যসৃষ্টি : তিনি শিক্ষা, সমাজসংস্কারের জন্য বহু সংস্কৃত বই বাংলা ভাষাতে অনুবাদ করেছিলেন। যেমন- বেদান্ত গ্রন্থ’, ‘বেদান্ত সার’, বিভিন্ন উপনিষদ। তার যুক্তিতর্কনির্ভর বিচারমূলক উল্লেখযােগ্য বই—‘উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার’, ‘গােস্বামীর সহিত বিচার’, কবিতাকারের সহিত বিচার’ প্রভৃতি। তিনি দেশীয় ছাত্রদের জন্য বাংলা ভাষায় ভূগােল, ব্যাকরণ, জ্যোতির্বিদ্যা বই লেখেন। 1815 থেকে 1830 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি প্রায় ত্রিশটি পুস্তক রচনা করেন। এ ছাড়া প্রবন্ধরচনা করেন।
[7] শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন : রামমােহন রায় ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য ইংরাজি বিদ্যালয় স্থাপনে সচেষ্ট হন। 1822 খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-বৈদিক স্কুল’ নামে তিনি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে মিশনারিদের সংযুক্ত করার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। এ ছাড়া হিন্দু কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনাতে তিনি সক্রিয়ভাবে সহযােগিতা করেছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে গোঁড়া হিন্দুদের জন্য হিন্দু কলেজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেননি।
[8] নারীশিক্ষা প্রসারে অবদান : তৎকালীন নারীর পড়াশােনার অধিকার ছিল না। অতি প্রাচীনকালে ভারতে নারীশিক্ষার প্রচলন ছিল। এ ব্যাপারে তিনি হিন্দুশাস্ত্র থেকে উদাহরণ সংগ্রহ করেন। তাই নারীদের শিক্ষার জন্য তীব্র দাবি রাখেন এবং তাদের আইনানুগ নানান অধিকার প্রচেষ্টায় সচেষ্ট হন। তার সৃষ্ট ব্ৰম্মসমাজের ব্রাম্ম বা নারীশিক্ষার জন্য দেশবাসীকে ভাবিয়ে ছিল।
[9] সমাজসংস্কারের মধ্য দিয়ে শিক্ষিত উন্নত নাগরিক সৃষ্টি : রামমােহন হিন্দু সমাজের কুসংস্কার মুক্তির জন্য নানা ধরনের সমাজসংস্কারের কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। জনগণ বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তিনির্ভর, সত্যানুসন্ধানী, বিশ্লেষণী দক্ষতা অর্জন করে— সে-ব্যাপারে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। দেশের প্রতিটি মানুষ যাতে একত্রিত হয়ে স্বাধীন চিন্তা ও ধ্যানধারণা করতে সক্ষম হয় সেজন্য আত্মীয়সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন।
উপসংহার :
ধর্মীয় গোঁড়ামি, নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ, কুসংস্কার, রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণ মনােবৃত্তির মানুষদের জন্য রামমােহন রায় হয়তাে সর্বতােভাবে সফল হতে পারেননি, তবুও এ কথা বলা যায় উত্তরকালে তাঁর চিন্তাধারার জয় হয়েছে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।
Thank you so much 😊🙂