শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারক উপাদানগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে। 

শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারক উপাদানগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।   Class 11 | শিক্ষার ধারণা ও লক্ষ্য (Education) 8 Marks

উত্তর:

শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারক উপাদানসমূহ : কোনাে কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার ক্ষেত্রে যে পূর্বপরিকল্পিত অভিপ্রেত স্থির করা হয়, তাই হল লক্ষ্য। শিক্ষা একটি বৃহৎ কাজ। এই কাজ সম্পাদনের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে-সমস্ত বিষয় বা উপাদান বিবেচনা করা হয়, তাদের বলা হয় শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারক উপাদান। নীচে শিক্ষার বিভিন্ন প্রকার লক্ষ্য নির্ধারক উপাদান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করা হল : 

[1] দার্শনিক মতবাদ : প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত যে-সমস্ত দার্শনিক মতবাদ বিভিন্ন যুগে প্রাধান্য লাভ করেছে, সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য হল—ভাববাদ, জড়বাদ, প্রকৃতিবাদ, প্রয়ােগবাদ ইত্যাদি। 

(i) ভাববাদী দর্শন অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হল আত্মবিকাশ ও আত্মােপলব্বিতে শিশুকে সহায়তা করা। 

(ii) জড়বাদী দর্শন অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হল বিজ্ঞান ও বৃত্তিশিক্ষার মাধ্যমে শিশুকে ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের উপযােগী করে গড়ে তােলা এবং তাকে বৃত্তি সংগ্রহে ও সার্থক সামাজিক জীবনে সাহায্য করা। 

(iii) প্রকৃতিবাদীদের মতে, বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও শিশুর অন্তঃপ্রকৃতি অনুযায়ী শিশুর পূর্ণ বিকাশ সাধনই হবে শিক্ষার লক্ষ্য। 

(iv) প্রয়ােগবাদীদের মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হবে নতুন নৈতিক মূল্য সৃষ্টি করা। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে দার্শনিক মতাদর্শ বিশেষভাবে প্রভাববিস্তার করে।

[2] মনােবিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি : ব্যক্তি সহজাতভাবে কিছু মানসিক সামর্থ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে। যেমন-বুদ্ধি, প্রক্ষোভ, স্মৃতি, কল্পনা, চিন্তন ইত্যাদি। শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই সামর্থ্যগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মনােবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিটি দেশের মানুষের মানসিক চাহিদা এক ধরনের হয় না। তাই এক-একটি দেশের মানবপ্রকৃতির ধারণার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। 

[3] ভৌগােলিক অবস্থান : ভৌগােলিক অবস্থার সঙ্গে শিক্ষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। কোনাে একটি দেশের শিক্ষার স্বরূপ নির্ভর করে, সেই দেশের ভৌগােলিক অবস্থানের ওপর। তাই শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভৌগােলিক অবস্থানকে বিবেচনা করা হয়। 

[4] রাজনৈতিক আদর্শ : শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আদর্শকেও বিবেচনা করা হয়। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামাের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানে শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষায় সমসুযােগ সৃষ্টি করা এবং সকলের জন্য প্রারম্ভিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের বিকাশ ঘটানাে। 

[5] অর্থনৈতিক পরিকাঠামাে : কোনাে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে যেমন শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষ করা যায়, তেমনি শিক্ষার বিকাশ ক্রিয়ায় অর্থনৈতিক উপাদান একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। তাই শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিকাঠামােকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। 

[6] সামাজিক উপাদান : কোনাে কোনাে সমাজ ও জাতির উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হল সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা। সেই কারণে বিশ্বের স্বাধীন দেশগুলি শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের সময় সমাজ ও জাতির কল্যাণের প্রতি নজর দেয় এবং সামাজিক উপাদানগুলিকে বিবেচনা করে। 

[7] ধর্মীয় উপাদান : প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের শিক্ষার ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেকটি দেশেই শিক্ষা শুরু হয়েছিল ধর্মপ্রচারের সহযােগী কাজ হিসেবে। আমাদের দেশের ব্রাত্মণ্য শিক্ষা শুরু হয়েছিল গুরুর আশ্রম ও মন্দিরকে কেন্দ্র করে। বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হয়েছিল বৌদ্ধ মঠ বা বিহারকে কেন্দ্র করে, ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হয়েছিল মসজিদকে কেন্দ্র করে। আধুনিক যুগেও ধর্মের মূলনীতি শিক্ষার্থীর জীবনবিকাশের কতকগুলি দিকে প্রভাবিত করে। তাই শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণে ধর্মীয় উপাদান বিবেচিত হয়। 

[8] সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য : যে-কোনাে দেশের শিক্ষার লক্ষ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়। শিক্ষার কাজ হল দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং সঞ্চালন। তাই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। 

[9] জ্ঞানের প্রসার : প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের কোনাে-না-কোনাে স্থানে নিত্যনতুন বিষয় আবিষ্কার হচ্ছে। প্রতিনিয়ত জ্ঞানেরও প্রসার ঘটেছে। সেই কারণে জ্ঞানের প্রসারের সঙ্গে সংগতি রেখে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। 

[10] জীবনযাত্রার মান : যে-কোনাে দেশের শিক্ষার লক্ষ্য সেই দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। জীবনযাত্রার মান সর্বদা পরিবর্তনশীল ও সমস্যাপূর্ণ। সেই কারণে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনগণের জীবনযাত্রার মান অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গৃহীত হয়।

[11] উন্নত জীবনাদর্শ : বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব ছাড়াও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উন্নত জীবনাদর্শও বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের অগ্রগতির জন্য শিক্ষা, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের জন্য শিক্ষা, চরিত্রগঠনের জন্য শিক্ষা, জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষা পরিপূর্ণ জীবন-জীবিকার জন্য শিক্ষা—এগুলিই হল উন্নত জীবনাদর্শের প্রকাশ। 

[12] আন্তর্জাতিক স্তরের শিক্ষার ভাবনা : জীবনব্যাপী শিক্ষা, সবার জন্য শিক্ষা, প্রথাবর্জিত শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক স্তরের শিক্ষা ভাবনার ফল। বিভিন্ন দেশের শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ধ্যানধারণাগুলিকেও বিবেচনা করা হয়।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment