সমাজসংস্কারমূলক কাজে রাজা রামমােহন রায়ের অবদান আলােচনা করাে।
উত্তর :
সমাজসংস্কারে রামমােহনের অবদান :
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় বিদ্যায় অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি ছিলেন কুসংস্কার মুক্ত, যুক্তিনির্ভর, যুক্তিবাদী, সমাজসচেতন জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব। তাঁর সমাজসংস্কার ও শিক্ষাসংস্কার-এর প্রয়াস ভারতবাসীর মধ্যে নতুন চেতনার পথ দেখিয়েছিল। তার গুরুত্বপূর্ণ সমাজসংস্কারমূলক কাজগুলি হল—
[1] বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিবারণ : তৎকালীন সময়ে ভারতীয়দের মধ্যে বাল্যকালে বিবাহ ও একাধিক বিবাহের প্রচলন ছিল। তিনি পত্রপত্রিকা, সংবাদ মাধ্যমের মাধ্যমে বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের কুফল তুলে ধরেন এবং মানুষকে সচেতন করেন। তাঁর রচিত সমাজ-সংক্রান্ত প্রবন্ধ প্রবর্তকনিবর্তক সংবাদ’-এর মধ্যে উল্লেখিত বিষয়ে তাঁর মতামত ও ‘প্রতিবাদ জানা গিয়েছিল।
[2] সতীদাহপ্রথা নিবারণ : তিনি সতীদাহপ্রথা বন্ধ করার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশজুড়ে জনমত ও আন্দোলন গড়ে তোলন। তিনি এ ব্যাপারে সম্বাদ কৌমুদি’ পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে প্রবন্ধ লেখেন। 1829 খ্রিস্টাব্দে তাঁরই প্রচেষ্টায় লর্ড বেন্টিঙ্ক আইনের মাধ্যমে এই বর্বর প্রথা বন্ধ করে দেন।
[3] জাতিভেদপ্রথা নিবারণ : সমাজের শােষক শ্রেণি জাতিভেদের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ঐক্য বিনষ্ট করে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে। তিনি এই প্রথার বিরােধী ছিলেন। এই প্রথার বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে বৌদ্ধগ্রন্থ ব্রজসুচির’ তিনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
[4] নারীর সম্পত্তিতে ও শিক্ষার অধিকার : ভারতীয় নারীর উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তিতে কোনাে অধিকার ছিল না। সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারদানের দাবিতে আইন তৈরি করার ব্যাপারে তিনি আন্দোলন, জনমত গড়ে তােলেন। প্রাচীন ভারতীয় নারীরা শিক্ষা, সংস্কৃতিতে পুরুষের সাথে সমানতালে অংশগ্রহণ করতেন—এ ব্যাপারে প্রবন্ধরচনা করেন। তিনি অনুভব করেছিলেন— নারীশিক্ষার প্রসার ছাড়া নারীমুক্তি সম্ভব নয়।
[5] বিবিধ সংস্কার : রামমােহন হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি দেবদেবী ও পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি একেশ্বরবাদ প্রচারে ব্রতী হন। এ ছাড়া সমাজের পণপ্রথার বিরুদ্ধে, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন (বিশেষত : কন্যাসন্তান) এর বিরুদ্ধে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি ধর্মবিরােধ দুর করে ‘সর্বধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল’ দেখিয়েছিলেন।
[6] সংবাদপত্রের স্বাধীনতা: ভারতবাসীর জাতীয়তার উন্মেষ, ভারতীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সংস্কার, শিক্ষার প্রসার প্রভৃতির জন্য তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বিশেষ হাতিয়ার করেছিলেন। কিন্তু পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেন। এর প্রতিবাদে তিনি সুপ্রিমকোর্ট ও পরে প্রিভি কাউন্সিলে রামমােহন রায় দরবার করেছিলেন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরাজ ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ‘প্রেস আইন’ প্রত্যাহার করে নেয়। এটি ছিল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় আইনি পদক্ষেপ। এ ছাড়া তিনি চাকরিক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন।
[7] ভারতীয়দের জন্য ইংল্যান্ডে সওয়াল : ভারতীয়দের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিযুক্ত কমিটির কাছে 1831 এবং 1832 খ্রিস্টাব্দে রামমােহন ইংল্যান্ডে গিয়ে সওয়াল করেন। তিনি গভর্নমেন্টের রাজস্ব, বিচার, সাধারণ জনসাধারণের জীবন ব্যবস্থা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। তাঁর প্রস্তাব 1833 সনের সনদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
[8] সমাজের প্রয়ােজনে প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা : তিনি সমাজের ও ধর্মের ত্রুটি দূরীকরণে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এই লক্ষ্যে তিনি ব্রাম্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া আত্মীয় সভা নামে 1815 খ্রিস্টাব্দে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিষয় আলােচনা, সামাজিক বিষয়ক আলােচনা, কুসংস্কার বিরােধী আলােচনা—এই আলােচনা ফলপ্রসূ যা জনগণকে ভাবিয়ে তােলে।
উপসংহার :
তিনি সামাজিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে উন্নত, আধুনিক ভারতের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।