সমাজতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশে বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান সমূহের অবদান আলােচনা কর। এই প্রসঙ্গে ভারতবর্ষে সমাজতত্ত্বের আলােচনা সম্পর্কে লেখ। Class 12 | Sociology (ভারতে সমাজতত্ত্ব) 8 Marks
উত্তর:
সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে সমাজতত্ত্ব যেমন নবীনতম, তেমনি প্রাচীনতম। সমাজতত্ত্বকে নবীনতম বলা হয় তার কারণ স্বতন্ত্র জ্ঞানবিদ্যা হিসাবে সমাজতত্ত্ব স্বীকৃতি পেয়েছে অতিসম্প্রতি। আবার এও বলা হয় যে, সামাজিক বিজ্ঞান সমূহের মধ্যে সমাজতত্ত্ব হল অন্যতম প্রাচীন। সভ্য সমাজ জীবনের সূত্রপাত থেকেই মানুষ সমাজ জীবন নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে। মানুষ ও তার নিয়তি, জনসম্প্রদায় ও মানব সভ্যতার উত্থান-পতন প্রভৃতি বিষয়ে একদল মানুষ নিরন্তর চিন্তা করে গেছেন। এরা সকলেই বস্তুত সমাজতাত্ত্বিক পথেই চিন্তা করে গেছেন। সুস্থ সামাজিক জীবন-যাপনের পথে মানুষ নানরকম সমস্যায় সম্মুখীন হয়েছে। এই অবস্থায় প্রয়ােজনের তাগিদে উদ্ভূত সমস্যাদির সুষ্ঠ সমাধানে মানুষ মনােনিবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। বস্তুত সমাজ জীবনের সমস্যাদি সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনার সূত্রেই দর্শনশাস্ত্রের মত সমাজতত্ত্বের আলােচনায় মানুষের আগ্রহ। এবং এই পথেই আবির্ভাব ঘটছে সমাজতত্ত্বের।
ভারতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাজতত্ত্বের চর্চা অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের বিষয়। কিন্তু ভারতে সমাজসম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনা আধুনিক কালের বিষয় নয়, অতীতের বিষয়। সুদীর্ঘকাল ধরে নিজস্ব স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজ সংক্রান্ত আলােচনা-গবেষণা এ দেশে চলে আসছে।
সমাজ সংস্কারমূলক সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারা: সমাজ সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে তত্ত্বনির্ভর। সমাজতাত্ত্বিক পর্যালােচনাও পরিচালিত হয়েছে। ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারার ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসাবে সমকালীন সমাজ সংস্কারকদের মধে উল্লেখযােগ্য হলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, রামমােহন রায় প্রমুখ।
ভারতীয় সমাজতত্ত্বের ভিত্তি: ভারতে ধর্ম সম্পর্কিত সমাজতাত্ত্বিক আলােচনায় বেদ-উপনিষদ রামায়ণ-মহাভারত, মনুসংহিতা ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র এবং শ্রীচৈতন্য, মহাবীর, বুদ্ধদেব, শ্রীরামকৃষ্ণ প্রমুখ। মহাপুরুষের বক্তব্য উপেক্ষা করা যায় না। তেমনি শিক্ষা সম্পর্কিত সমাজতান্ত্রিক আলােচনায় রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ মনীষীদের মতবাদ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলােচনায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক।।
দৃষ্টবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: ভারতে সমাজতত্ত্ব বিষয়টির গুরুত্ব প্রথম প্রচার করেন পাদরি লঙ সাহেব ১৮৬১ সালে। ১৮৬৭ সালে “বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভা” নামে একটি সংস্থা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬১ সালে বেথুন সােসাইটির সমাজতত্ত্ববিভাগ আলােচনা ও গবেষণার জন্য কতকগুলি সমাজতাত্ত্বিক বিষয়কে চিহ্নিত করে। স্যামুয়েল লব ভারতে প্রথম দৃষ্টবাদ প্রবর্তন করেন। ভারতে দৃষ্টবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজব্যবস্থা বা সামাজিক বিষয়াদি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন দ্বারকানাথ মিত্র, রমেশচন্দ্র মিত্র, কৃষ্ণনাথ মুখােপাধ্যায়, যােগেন্দ্র চন্দ্র ঘােষ প্রমুখ।
প্রাচীন ভারতের শাস্ত্রসমূহ: এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রসমূহের উল্লেখ আবশ্যক। পুরান-উপনিষদ ও অন্যান্য প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহে বিভিন্ন সামাজিক তত্ত্ব ও সমস্যাদির অবতারণা পরিলক্ষিত হয়। ভারতের “বৈদিক সাহিত্যসমূহ” ও “কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সামাজিক তত্ত্ব ও তথ্যাদির এক সমৃদ্ধ আধার হিসাবে বিবেচিত হয়। এই প্রসঙ্গে মনুসংহিতার কথা বলা দরকার। মনুসংহিতায় সামাজিক বিধিসমূহ (laws of Manu) সম্পর্কে বিশদভাবে আলােচনা করেছে। এ প্রসঙ্গে “নীতিশাস্ত্র”, “অর্থশাস্ত্র” ও “আইন-ই-আকবরী”-র কথাও উল্লেখ করা আবশ্যক। নীতিশাস্ত্র নীতি বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে আর্থ-সামাজিক, রাজনীতিক ২৯ প্রভৃতি সমস্যা সম্পর্কেও আলােচনা করা হয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র হল অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি ও আইনের এক অত্যন্ত বাস্তববাদী ও শুদ্ধ তাত্ত্বিক আলােচনায় সমৃদ্ধ গ্রন্থ।
ভারতবর্ষে সমাজতত্ত্বের আলােচনা: ভারতবর্ষে সমাজতত্ত্বের আনুষ্ঠানিক আলােচনা হয় ১৯১৯ সালে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে একেবারে স্বতন্ত্র একটি শাস্ত্র হিসাবে সমাজতত্ত্বের পঠন-পাঠন শুরু হয়। ১৯৩০ সালে এদেশের ছাত্রদের মধ্যে সমাজতত্ত্ব ক্রমশঃ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিকগণ ভারতবর্ষের গ্রাম ও গ্রামীণ সমাজ জীবন, সামাজিক পরিবর্তন, জাতিভেদ প্রথা, পরিবার, বিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনা করেছেন। ভারতীয় সমাজতত্ত্বকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে নির্মল কুমার বসু, বিনয়কুমার সরকার, রাধাকমল মুখার্জী, এম.এন. শ্রীনিবাস, এস. সি. দুবে প্রমুখর অবদান অবিস্মরণীয়।
বাংলায় সমাজতত্ত্বের আলােচনা: নবজাগরণের ঘটনা সমাজতাত্ত্বিক অনুশীলনকে প্রভাবিত করে। এই সময় কতকগুলি পত্র-পত্রিকার আলােচনায় সমাজতাত্ত্বিক ও নৃবিজ্ঞানমূলক তথ্যাদি পরিবেশিত হতে দেখা যায়। তত্ত্ববােধিনী, বিদ্যাদর্শন প্রভৃতি পত্রিকার নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য।
এশিয়াটিক সােসাইটি: উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতে সমাজতাত্ত্বিক চর্চার ইতিহাসকে উপেক্ষা করা যাবে না। কালগত দিক থেকে বিচার করলে ভারতে ও পশ্চিমে সমাজতত্ত্বের চর্চা প্রায় সমকালীন। ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সােসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় স্যার উইলিয়াম জোক্স-এর উদ্যোগে। ভারতের বৌদ্ধিক ইতিহাসে এটি একটি বড় ঘটনা।
বেথুন সোসাইটি: ভারতের সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারার ইতিহাসে ১৮৬১ সালটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরেই সমাজতত্ত্ব চর্চার বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিকরণ ঘটেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে বেথুন সােসাইটি কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাজতত্ব চর্চার ক্ষেত্রে পুরােধা হিসাবে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করে।
বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভা: সমকালীন ভারতে বেথুন সােসাইটির আদলে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলি একটি বৌদ্ধিক পরিবেশ-পরিমণ্ডলের সৃষ্টি করে। সংশ্লিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে “বঙ্গীয় সমাজ বিজ্ঞান সভা”-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এটি ১৮৬৭ সালে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিকদের ভূমিকা: ভারতবর্ষে সমাজতত্ত্বের পঠন-পাঠনকে আরাে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত। ভারতবর্ষের সমাজ নিয়ে তার বিখ্যাত গ্রন্থ হল “Studies in Indian Social Polity.” এছাড়াও গােবিন্দ সদাশিব ঘুরে ১৯২৪-১৯৫৯ সাল পর্যন্ত বােম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক থাকাকালীন সমাজতত্ত্ব বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে উন্নত করার চেষ্টা করেন। ১৯৫২ সালে প্রধানত তারই প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে “Indian Sociological Society”।একটি মুখপত্র “Sociological Bulletin” ও তিনি প্রকাশ করেন। এরপর তার সুযােগ্য ছাত্র এম. এন. শ্রীনিবাস সমাজতত্ত্বকে সবার সামনে জনপ্রিয় করেন তার বিখ্যাত “Sanskritization” ও “Westernization” তত্ত্বের মাধ্যমে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।