তুলনামূলক শিক্ষার প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করো
উত্তর :
বিভিন্ন শিক্ষাবিদের সংজ্ঞাগুলিকে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে শিক্ষার যে সংজ্ঞা গড়ে তােলা যায় তা সংক্ষেপে হলাে—(ক) শিক্ষার ইতিহাসকে বর্তমান পর্যন্ত বিস্তৃত করে নিয়ে তার বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী সমীক্ষাই তুলনামূলক শিক্ষার উপজীব্য। (খ) বিভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য ঘটে যেসব জাতীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কারণ ও সমাধানের জন্য তাদের বৈশিষ্ট্য ও পারস্পরিক মিলঅমিলের ক্ষেত্রগুলিকে আবিষ্কার করাই তুলনামূলক শিক্ষার কাজ। (গ) একটি দেশের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যে বিদ্যায় বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপ্রযুক্তি, শিক্ষাতত্ত্ব, শিক্ষাসমস্যা সমাধানের পদ্ধতি বিষয়ে তুলনামূলক আলােচনা দ্বারা গভীর ও ব্যাপক ধারণা গড়ে তােলা যায়, তাকে তুলনামূলক শিক্ষা বলে।
তুলনামূলক শিক্ষার প্রভাব :
শিক্ষা ব্যক্তি তথা সমাজকে উন্নত করে। ব্যক্তির আচরণকে শিক্ষা যেমন কাঙ্ক্ষিত, বাঞ্ছিত ও সুনিয়ন্ত্রিত করতে ভূমিকা রাখে, তেমনি সমাজ কলুষমুক্ত হয়ে উন্নত থেকে উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছাতে সাহায্য করে। এস. ভি. এস জেফব্রিস শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেন, প্রকৃত অর্থে কৃষ্টি যেমন সংরক্ষণ করে, তেমনি নতুনত্ব আনয়ন ও পরিচলন ক্ষেত্রেও প্রভাবিত করে। শিক্ষার শুরু সেই আদিম যুগ থেকে। তখন মানুষের চাহিদা ছিল শুধুমাত্র খাদ্যগ্রহণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই পশুশিকার করে কীভাবে সফল হয়ে ফিরে আসা যায় তা শিক্ষা দেওয়া হতাে। জীবন বাঁচানােও ছিল শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়। এই শিক্ষা অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও পরবর্তীতে তা প্রসারলাভ করে। শিক্ষায় যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে ভিন্নতা আসতে শুরু করে। আর এই শিক্ষাগ্রহণের ফলে মানুষের যে পরিবর্তন হয় তা তাকে উন্নত ও আদর্শবান করে গড়ে তুলতে প্রভাবিত করে।
মানুষ তার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নানা ধরনের শিক্ষাগ্রহণ করতে চায়। নিজের পরিচিত মণ্ডলের বিভিন্ন দিকে জ্ঞান অর্জনের পর পার্শ্ববর্তী এবং দূরবর্তী দেশগুলির নানা দিকের শিক্ষাঅর্জনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এসব শিক্ষাগ্রহণ করার পর মানুষ বিভিন্ন দেশের
উপাদানগত তথ্যের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নিরূপণ করার বিষয়ে আগ্রহী হয়। এছাড়াও নিজ দেশের সঙ্গে অন্য দেশের শিক্ষা উপাদানের তুলনা করতেও উদ্যোগী হয়।
মানুষের জানার আকাঙ্ক্ষা সীমাহীন। উনিশ শতক হতে শিক্ষাবিদগণের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা অধ্যয়নে উৎসাহ দেখা যায়। শিক্ষাবিদগণ নিশ্চিত হন যে, সংস্কৃতি বা কৃষ্টির উন্নয়নে ব্যক্তির যােগ্যতা সর্বাধিক। আর এই যােগ্যতা অর্জনের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সংস্কৃতি বা কৃষ্টির নির্ধারক বলতে তারা মানুষের বিশ্বাস, ধর্ম, জ্ঞান, আচার-অনুষ্ঠান, প্রথা, মূল্যবােধ, সামাজিক ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রভৃতিকে মনে করেন। অতএব বলা যায়, মানুষের সমগ্র জীবন-পরিবেশ হচ্ছে সংস্কৃতির সমার্থক। সুতরাং এই সংস্কৃতির মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে সমাজ উপযােগী করে গড়ে তােলার শিক্ষালাভ করে। সে কারণে মানুষ চায় পরিমণ্ডলের বাইরে থেকেই শিক্ষা অর্জন করতে। উপলদ্ধি করতে চায় নিজের চারপাশ হতে যে শিক্ষা সে গ্রহণ করছে তার মধ্যে যথার্থতা, আধুনিকতার স্বরূপ। আর এই সূত্র ধরেই প্রয়ােজন হয় বিভিন্ন দেশের শিক্ষা অধ্যয়নের।
তুলনামূলক শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা :
আধুনিক তুলনামূলক শিক্ষার জনক স্যাডলার বিদেশি শিক্ষার অধ্যয়নের প্রতি গুরুত্ব আরােপ করেন। তিনি এই সম্বন্ধে বলেন, বিদেশি শিক্ষা অধ্যয়ন করা উচিত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, উদার ও নিরপেক্ষ মনােভাব নিয়ে এবং তার সঙ্গে স্বদেশি শিক্ষার বিষয়বস্তুও গভীরভাবে উপলব্ধি করা উচিত। তিনি বিভিন্ন দেশের শিক্ষার ভালাে দিকগুলিকে নিজের দেশের শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন। এছাড়া দেশের বাস্তব অবস্থার কথা চিন্তা করে বিদেশি শিক্ষার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানাের প্রয়ােজন বলে মনে করেন। এই প্রসঙ্গে ম্যান বলেন, বিদেশি শিক্ষার কোনাে দিক গ্রহণ করার পূর্বে উক্ত দেশের যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ তাদের শিক্ষার রূপদান করেছে তা ভালােভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। এরপরও আধুনিক শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সমালােচকগণ বিদেশি শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করেন এবং স্বদেশের শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে বিদেশি শিক্ষা অনুসরণ করার জন্য নির্দেশনা দান করেন।
1) শিক্ষাব্যবস্থা সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে।
2) অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
3) শিক্ষার সমস্যা ও সমস্যার কারণ নির্ণয় করতে সমর্থ হন।
4) বিভিন্ন দেশের শিক্ষা বিষয়ক অধ্যয়নের ফলে শিক্ষার বিভিন্ন দিকের সাদৃশ্য, বৈসাদৃশ্য সম্পর্কে ভালােভাবে জানা সম্ভব হয় এবং তার দ্বারা শিক্ষার জগৎ সমৃদ্ধ হয়।
5) দেশের শিক্ষার নানাবিধ সমস্যা সমাধানে বিদেশি শিক্ষার গুরুত্ব উপলদ্ধিকরণে সচেষ্ট হয়।
6) বিভিন্ন দেশের শিক্ষা অধ্যয়ন করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়।
7) তুলনামূলক শিক্ষার মাধ্যমে পেশাগত অবস্থান সুদৃঢ়করণে যথাযথ ভূমিকা পালন করা হয়।
বর্তমান যুগে তুলনামূলক শিক্ষার অধ্যয়ন নানাভাবে শিক্ষাজগৎকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। সকল শিক্ষাবিদ তাঁদের বিভিন্ন শিক্ষা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে এই বিষয়ের অভিজ্ঞতা প্রয়ােগ করে সুফল পাচ্ছেন। এছাড়া আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও পরিকল্পনাবিদগণ দেশের নানাবিধ সমস্যা তথা শিক্ষাসমস্যা সমাধানে বিদেশি শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে এবং তা প্রয়ােগে সচেষ্ট হন। শিক্ষাবিদগণও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা অধ্যয়ন করে নিজেদের আরও দক্ষ এবং অভিজ্ঞ করতে পারেন যা তাদের পেশাগত অবস্থান সুদূঢ়করণের সহায়ক।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।