প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, এখানে আমরা ভগিনী নিবেদিতা | উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আলোচনা করলাম। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে এই প্রবন্ধ রচনাটি লেখা হয়েছে। আশা করি তোমাদের সবারই ভালো লাগবে। ধন্যবাদ
ভগিনী নিবেদিতা
সোনালী চুলেই থাকে নদীর ইশারা
সে নারীর যার নীল চোখ খোঁজে পূবের আকাশ
……………………………………………………………………………….
ভগ্নীর প্রীতির মতো নিবেদিতা প্রভা
দ্যাখে ওই সহৃদয় দেশ, তার তৃণ-ফুল ঘাস
—’ভগিনী নিবেদিতা’, সঞ্জয় ভট্টাচার্য
মহামানবের সাগরতীর এই ভারতবর্ষ যুগে যুগে অজস্র মহাপুরুষের আগমনে সমৃদ্ধ হয়েছে। “দেবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে”—এই আদর্শকে পাথেয় করে এখানে বহু বিদেশি পণ্ডিত ও মনীষীদের আবির্ভাব ঘটেছে। এই দেশকে তারা আপন করে নিয়েছেন। অ্যানি বেসান্ত থেকে মাদার টেরেসার আগমনের সেই ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত নয়, আর ভগিনী নিবেদিতা সেই তালিকায় এক উজ্জ্বল উপস্থিতি।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা: ১৮৬৭-র ২৮ অক্টোবর, উত্তর আয়লান্ডের টাইরনে নিবেদিতার জন্ম। পিতা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেল ছিলেন ধর্মযাজক। মায়ের নাম মেরি ইসাবেল নোবেল। পূর্ব নাম ছিল মিস মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল। মাত্র ১৩ বছর বয়সে মার্গারেটের মনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন জাগে। স্কুল-জীবনেই মিলটন, শেকসপিয়র, আয়ার্ল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। কুড়ি বছর বয়সে নিজেকে দরিদ্র মানুষের সেবার উপযোগী করে তুলবেন বলে শিক্ষিকার চাকরি ছেড়ে এক অনাথাশ্রমে যোগ দেন। রেক্সহ্যামের খনি অঞ্চলে শিক্ষকতা করতে এসে একুশ বছর বয়সে চার্চের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ করেন। এই সময়ে মার্গারেটকে সমাজসমস্যা এবং রাজনীতি নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে দেখা যায়। এমার্সন, রাসকিন—তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। তারপরেই পেস্তালৎসি এবং ফ্রয়েবেলের আদর্শে তিনি প্রগতিশীল শিক্ষাভাবনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাকে ঘিরেই লন্ডনে তরুণ সাহিত্যিকদের একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়। নিবেদিতা এই সময়ই বুয়র যুদ্ধ নিয়ে প্রবন্ধ লিখছেন উইম্বলডন নিউজ-এ। তাঁর রাজনীতির ভাবনা প্রকাশ পাচ্ছে ডেইলি নিউজএ। আবার বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা লিখছেন রিসার্চ নামক পত্রিকায়। এই সময়ই তিনি হয়ে উঠেছেন ফ্রি আয়ার্ল্যান্ডের সক্রিয় কর্মী। সময় কাটিয়েছেন বিখ্যাত সব রাজনৈতিক চিন্তাবিদের সঙ্গে। ম্যাকলিনের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন সিসেম ক্লাব; যেখানে নিয়মিত এসেছেন বার্নার্ড শ, হাক্সলির মতো বিদগ্ধ মানুষেরা। তাঁর বিস্ময়কর কর্ম উন্মাদনার মধ্যে কোনোরকম বিস্ময় থাকে না যখন এক ভারতীয় সন্ন্যাসীর আহ্বান পৌঁছে যায় মার্গারেটকে লেখা চিঠিতে – “তুমি ঠিক সেই নারী যাকে এদেশের আজ প্রয়োজন।”
বিবেকানন্দ ও নিবেদিতা: ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের এক বিকেলে লন্ডন ওয়েস্ট এন্ড-এর এক অভিজাত বাড়িতে মার্গারেটের সঙ্গে বিবেকানন্দের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেখানে বিবেকানন্দের বেদান্তের ব্যাখ্যা আলোড়ন তুলেছিল মার্গারেটের মনে। এরপরে বিবেকানন্দের অনুগামী হয়ে লন্ডনের প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি হাজির হন এবং প্রশ্নের মধ্য দিয়ে নিজের যাবতীয় সংশয়কে তিনি দূর করে নেন। ১৮৯৮-এর ২৮ জানুয়ারি মার্গারেট ভারতে আসেন এবং ২৫ মার্চ বিবেকানন্দ তাঁকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দেন। মার্গারেট রূপান্তরিত হন ভগিনী নিবেদিতায়। “ভারতের কল্যাণেই জগতের কল্যাণ”– স্বামীজীর এই আদর্শই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনাদর্শ।
নিবেদিতা ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম: ব্রিটিশ বিরোধিতায় নিবেদিতা ছিলেন দ্বিধাহীন। “ভারতবর্ষ স্বাধ্যায়-এ মগ্ন ছিল। একদল দস্যু এসে তার জমি জারাত ধ্বংস করল তাদের তাড়িয়ে দিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য করতে হবে স্বস্থানে।” এই ইংরেজ বিরোধিতাই নিবেদিতাকে নিয়ে এসেছিল অরবিন্দের সান্নিধ্যে, তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল গুপ্ত বিপ্লবীদের সাহায্য করার জন্য কিংবা, কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করতে। বিপিনচন্দ্র পাল তার সম্পর্কে বলেছেন– She was a great hater of British Raj and great lover of Indians. এমনকি বিপ্লবীদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এতটাই ছিল যে বরোদার মহারাজাকে তিনি অনুশীলন সমিতির মতো বিপ্লবী সংগঠনকে অর্থ সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেন ।
লোকমাতা নিবেদিতা: রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতাকে বলেছিলেন ‘লোকমাতা’। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্লেগ মহামারির চেহারা নিলে স্বামী সদানন্দকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সেবাকার্যে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। বাগবাজারে তার বাড়ি ১৫ নং বোসপাড়া লেন হয়ে ওঠে মানবতার ভিত্তিভূমি। সন্তোষিণী, পুরাঙ্গনা থেকে বিখ্যাত গোপালের মা সকলেই তাঁর কাছে অনায়াস আশ্রয় পেয়েছে।
নারীশিক্ষা ও নিবেদিতা: নিবেদিতা নিশ্চিতভাবে বুঝেছিলেন যে মেয়েদের শিক্ষা না হলে সমাজ এগোবে না। তাই অজস্র প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের বাসস্থানে তিনি মেয়েদের জন্য স্কুল তৈরি করেছিলেন। একদিকে প্রাচীন ভারতীয় আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যদিকে আধুনিক চিন্তাভাবনাকে গ্রহণ এই দুই-এ মিলে তাঁর শিক্ষা আদর্শ গড়ে উঠেছিল। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদেরকে যেভাবে তিনি শিক্ষিত করে তুলতে উদ্যোগ নেন তা ছিল এক সামাজিক লড়াই। গিরিবালা ঘোষ থেকে প্রফুল্ল দেবী—সেই লড়াইয়ের সাফল্যের এক-একটা নাম। মিশনারিদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ভারতীয় মেয়েদের হয়ে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
উপসংহার: ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অক্টোবর নিবেদিতার মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর কাজ এবং আদর্শের মধ্য দিয়ে তিনি এক মৃত্যুহীন প্রাণ। আজকের প্রজন্মের কাছেও নিবেদিতা প্রেরণার উৎস। ধর্ম নিয়ে বিক্ষুব্ধ এবং সংঘাতময় ভারতে নিবেদিতাই হতে পারেন অন্ধকারে আলোর দিশা।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।
Very 😞
অপূর্ব সুন্দর