ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে বায়ুর উষ্ণতার তারতম্যের কারণগুলি সংক্ষেপে লেখাে।

ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে বায়ুর উষ্ণতার তারতম্যের কারণগুলি সংক্ষেপে লেখাে। অথবা, বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় ? Class 10 | Geography | 5 Marks

উত্তর: বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতার তারতম্যের কারণ ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে বায়ুর উষ্ণতায় অনেক পার্থক্য দেখা যায়। বায়ুর উষ্ণতার এই তারতম্যের নিয়ন্ত্রকগুলি হল—

1. অক্ষাংশ: অক্ষাংশ অনুসারে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে সূর্যরশ্মির পতনকোণের তারতম্য ঘটে, ফলে উষ্ণতারও পার্থক্য হয়। নিরক্ষরেখা থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে সূর্যরশ্মি ক্রমশ তির্যকভাবে পড়ে। লম্বভাবে পতিত সূর্যরশ্মির তুলনায় তির্যকভাবে পতিত সূর্যরশ্মিতে উত্তাপের পরিমাণ কম হয়। এর কারণগুলি হল— a) ঐতিক রশ্মিকে বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে তুলনামূলকভাবে অধিক দুরত্ব অতিক্রম করতে হয় এবং b) তির্যক রশ্মি ভূপৃষ্ঠে বেশি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং, নিরক্ষরেখা থেকে উত্তর ও দক্ষিণে তাপমাত্রাও ক্রমশ কমতে থাকে। 

উদাহরণ: 34°05’ উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত শ্রীনগরের তুলনায় নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী তিরুবনন্তপুরম (৪°31’ উ: অক্ষাংশ) অনেক বেশি উষ্ণ। আর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অক্ষাংশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলেই অক্ষাংশের ভিত্তিতে। ভূপৃষ্ঠে তিনটি প্রধান তাপমণ্ডলের সৃষ্টি হয়েছে।

2. উচ্চতা : সাধারণভাবে দেখা যায় প্রতি 1000 মিটার উচ্চতায় প্রায়। 6.4°সে হারে তাপমাত্রা হ্রাস পায়। তাই একই অক্ষাংশে অবস্থিত হলেও সমতল স্থানের তুলনায় উঁচু স্থানের তাপমাত্রা কম হয়। 

উদাহরণ : উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা (0°20′ উত্তর, উচ্চতা 1190 মি) এবং ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটো (0°11′ দক্ষিণ, উচ্চতা 2850 মি) মােটামুটি একই অক্ষাংশে অবস্থিত হলেও উচ্চতার পার্থক্যের জন্য কাম্পালার (গড় বার্ষিক তাপমাত্রা 19°সে) তুলনায় কুইটোর তাপমাত্রা (গড়ে 8.5 °সে) অনেক কম।

3. স্থলভাগ ও জলভাগের বন্টন : জলভাগের তুলনায় স্থলভাগ দিনের বেলা তাড়াতাড়ি গরম হয় এবং রাতে তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়। একইভাবে গ্রীষ্মকালে স্থলভাগ যতটা উষ্ণ হয় পার্শ্ববর্তী জলভাগ ততটা হয় না বা শীতকালে স্থলভাগ যতটা শীতল হয় সংলগ্ন জলভাগ ততটা শীতল হয় না। এজন্য সমুদ্র থেকে দূরে মহাদেশের অভ্যন্তরে জলবায়ু চরম বা মহাদেশীয় প্রকৃতির হয়। কিন্তু সমুদ্রসংলগ্ন স্থানে সামুদ্রিক প্রভাবের জন্য উষ্ণতা কখনােই খুব বেশি বা কম হয় না। জলবায়ু সমভাবাপন্ন হয় 

উদাহরণ: সমুদ্র থেকে দূরে দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত বলে দিল্লির জলবায়ু চরম বা মহাদেশীয় প্রকৃতির। আবার, সামুদ্রিক প্রভাবের জন্য মুম্বাইয়ের জলবায়ু সমভাবাপন্ন। 

4. ভূমির ঢাল : ভূমির যে ঢালের ওপর সূর্যালােক বেশি খাড়াভাবে পড়ে সেই ঢালে উষ্ণতা অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। এর বিপরীত ঢালে সূর্যালােক তির্যকভাবে পড়ে ও উষ্ণতা তুলনামূলকভাবে কম হয়। 

উদাহরণ :উত্তর গােলার্ধে হিমালয়, আল্পস প্রভৃতি পর্বতশ্রেণির উত্তর ঢালের তুলনায়। দক্ষিণ ঢালের তাপমাত্রা বেশি। আবার দৃক্ষিণ গােলার্ধের পর্বতশ্রেণিসমূহের উত্তর ঢাল দক্ষিণ ঢালের তুলনায় বেশি উষ্ণ

5. বায়ুপ্রবাহ: বায়ুপ্রবাহ তাপ বহন করে। তাই কোনাে অলের। ওপর দিয়ে উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হলে সেখানকার তাপমাত্রা বাড়ে এবং শীতল বায়ুপ্রবাহে তাপমাত্রা কমে। 

উদাহরণ : শীতকালে সুমেরর। ঠান্ডা বাতাস উত্তর আমেরিকা মহাদেশের অভ্যন্তরে বহুদূর পর্যন্ত চলে আসে। এজন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যভাগে শীতকালে তীর। শীত পড়ে এবং তুষারপাত হয়। আবার উম্ন চিনুক বায়ুর প্রভাবে ওই দেশটিরই প্রেইরি অঞলে শীতকালে বরফ গলে যায়।

6. মেঘাচ্ছন্নতা ও অধঃক্ষেপণ: আকাশে ঘন মেঘের আবরণ একদিকে যেমন দিনের বেলা সৌরশক্তিকে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছােতে বাধা দেয়, অপরদিকে রাত্রি বেলা ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকীর্ণ তাপকেও মহাশনে পোঁছােতে দেয় না। ফলে মেঘের আবরণ থাকলে দিনের বেলা উত্তাপ কমে, আর রাত্রিবেলা উত্তাপ বাড়ে। এই কারণে মেঘশন রাত্রির তুলনায় মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি অনেক গরম হয়। বৃষ্টিপাত, শিলাবৃষ্টি। তুষারপাত প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার অধঃক্ষেপণে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা হাস। পায়। এজন্য বৃষ্টিহীন রাজস্থান মরু অঞলের তুলনায় বৃষ্টিপাত অধ্যুষিত চেরাপুঞ্জির তাপমাত্রা অনেক কম। আবার, বৃষ্টিপাতের তুলনায় শিলাবৃষ্টি এবং শিলাবৃষ্টির তুলনায় তুষারপাতে তাপমাত্রা হ্রাস পায়।

অন্যান্য কারণ

1. সমুদ্রস্রোত : সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত যে-কোনাে দুটি স্থান। একই অক্ষাংশে অবস্থিত হলেও একটির পাশ দিয়ে যদি উষ্ণ স্রোত এবং অপরটির পাশ দিয়ে যদি শীতল স্রোত প্রবাহিত হয়, তাহলে প্রথম স্থানটির আবহাওয়া উষ্ণ এবং দ্বিতীয় স্থানটির আবহাওয়া শীতল হয়। 

উদাহরণ : প্রায় একই অক্ষাংশে। অবস্থিত গ্রেট ব্রিটেনের গ্লাসগাে শহরের পাশ দিয়ে উষ্ণ উত্তর। আটলান্টিক স্রোত এবং কানাডার নৈন শহরের পাশ দিয়ে শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত প্রবাহিত হয়। এর ফলে শীতকালে গ্লাসগাের গড় তাপমাত্রা যখন 4.3°সে-এর নীচে নামে না, তখন নৈনের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে – 18.5°সে পর্যন্ত নেমে যায়।

2. স্বাভাবিক উদ্ভিদ : উদ্ভিদ বিভিন্নভাবে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে প্রভাব বিস্তার করে, যেমন—a) প্রস্বেদন প্রক্রিয়া: গাছ। প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বায়ুতে জলীয় বাষ্প সংযুক্ত করে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমায়। b) ছায়াপ্রদান: দিনের বেলা ছায়াপ্রদান করে। গাছ বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমাতে সাহয্য করে। c) কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ; সালােকসংশ্লেষের জন্য বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণের মাধ্যমে উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।

3. মৃত্তিকা : বিভিন্ন প্রকার মৃত্তিকার তাপগ্রহণ ও বিকিরণ ক্ষমতা একরকম নয় বলে মৃত্তিকার পার্থক্যে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রারও তারতম্য হয়, যেমন— a) মাটির প্রকার: পলিমাটির তুলনায় ল্যাটেরাইট মাটির তাপগ্রহণ ও বিকিরণ ক্ষমতা অধিক। তাই পলিমাটিসমৃদ্ধ গঙ্গা বদ্বীপের তুলনায় ল্যাটেরাইট মাটি অধ্যুষিত পুরুলিয়ায় দৈনিক তাপমাত্রার প্রসরও অনেক বেশি। b) মাটির আর্দ্রতা: আবার, আর্দ্রতা মাটির তুলনায় শুষ্ক মাটি দ্রুত উত্তপ্ত ও শীতল হয়। এজন্য রাজস্থানের শুষ্ক মৃত্তিকা অঞ্চলের তুলনায়। গঙ্গা সমভূমির আর্দ্র মৃত্তিকা অঞলে উষ্ণতা কম। 

4. নগরায়ণ ও শিল্পায়ন : a) শহরাঞ্চলে রাস্তা ও বাড়ি তৈরির উপাদান: শহর, নগর, শিল্পাঞ্চলের বেশিরভাগ ভূমিই ইট, সিমেন্ট, কংক্রিটের বাড়ি ও রাস্তায় ঢাকা থাকে। আর এইসব উপাদান দ্রুত উত্তপ্ত হয় বলে শহর, নগর, শিল্পকেন্দ্রের তাপমাত্রা বেশি হয়। b) কলকারখানার নির্গত তাপ: শিল্পাঞ্চলের। কলকারখানা নির্গত তাপেও বায়ুমণ্ডল বেশি উত্তপ্ত হয়। c) গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ: অধিক সংখ্যায় যানবাহন ও কলকারখানা নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনােক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড প্রভৃতি গ্রিনহাউস গ্যাস বেশি পরিমাণে তাপ শােষণ করে এইসব স্থানের বায়ুর উত্তাপ বাড়িয়ে দেয়।।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment