উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি আলোচনা করো

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি আলোচনা করো ।
উনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণের চরিত্র, প্রকৃতি ও বিতর্ক সম্পর্কে আলোচনা করো ।

উত্তরঃ-

‘রেনেসাঁ’- একটি ফরাসি শব্দ। যার আক্ষরিক বাংলা অর্থ হলো নবজাগরণ। উনিশ শতকে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন রাজনীতি – প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদ এর ধারায় এক বিশাল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, একেই ঐতিহাসিকরা নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন।

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি
বাংলার নবজাগরণ

নবজাগরণের স্রষ্টা: পশ্চিমের জ্ঞান-বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, দর্শন, মানবতাবাদ, উদারনীতিবাদ প্রভৃতি বাঙালি মনোজগতে এক অভূতপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল। আর এই পরিবর্তনই নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটায়। উনিশ শতকে বাংলায় ‘রেনেসাঁস’ সম্পর্কে প্রথম বক্তব্য রেখেছিলেন যদুনাথ সরকার। তার মতে উনিশ শতকে বাংলায় রেনেসাঁস হল ব্রিটিশ শাসনের সবথেকে বড় অবদান। এর ব্যাপ্তি ইউরোপীয় রেনেসাঁস কে ছাপিয়ে গিয়েছিল।

নবজাগরণের পৃষ্ঠপোষক: উনিশ শতকের নবজাগরণে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্য বাদী উভয় শ্রেণীর অবদান ছিল। প্রাচ্যবাদীরা হিন্দুশাস্ত্র গুলি কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্য বাদীরা পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরুত্ব বুঝে ছিলেন। আধুনিক পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সমন্বয়ে তৈরি মিশ্র সংস্কৃতি উনিশ শতকের বাংলায় এক উন্নতমান শ্রেণীর জন্ম দিয়েছিল। এই উন্নতমান শ্রেণীই ছিল নবজাগরণের মূল পৃষ্ঠপোষক।

নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি:

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক একে প্রকৃত নবজাগরণ বলে মেনে নিয়েছেন, আবার কেউ কেউ মেনে নেয়নি। উনিশ শতকের নবজাগরণ নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে।

সপক্ষে যুক্তি:-

বাংলার নবজাগরণ – তৎকালীন সময়ে ‘রামমোহন রায়’- আলেকজান্ডার ডাফ কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন – “আমি ভাবতে শুরু করেছি, ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মতো কিছু একটা ভারতে ঘটতে চলেছে”। রামমোহন রায়ের মত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশব চন্দ্র পাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ উনিশ শতকের বাংলার মানসিক স্ফুরণ ও সংস্কারের আন্দোলনকে নবজাগরণ বলেছেন।

বাংলার নবজাগরণ এর ভিত্তি – নবজাগরণ বলতে শুধু প্রাচীন দেশীয় ও ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নতুন মূল্যায়নের প্রচেষ্টাকে বোঝায় না। এই সময় ইংরেজি শিক্ষার ও ইউরাপেীয় সংস্কৃতির ছোঁয়ায় বাঙালি আত্মসচেতন হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিরা পাশ্চাত্যের সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বাঙালি নিজের ধর্মীয়, সামাজিক ত্রুটিবিচ্যুতি এবং সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের চরিত্র সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে। এই সচেতনতার ফলেই নবজাগরণের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলায় নবজাগরণের গভীরতা – ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার তার ‘বাংলার ইতিহাস’ গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলাকে ‘নবজাগরণের পীঠস্থান’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে নবজাগরণ দেখা যায়, উনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল তার থেকেও ব্যাপক, গভীর এবং বৈপ্লবিক”।

বুর্জোয়া অর্থনীতি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব – অধ্যাপক ‘সুশোভন সরকারের’ বর্ণনায় বাংলার নবজাগরণে বুর্জোয়া অর্থনীতি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তার মতে, বাংলায় সর্বপ্রথম ব্রিটিশ আমলে বুর্জোয়া অর্থনীতি ও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূত হয়। তার ফলে যে সংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছে তাকেই নবজাগরণ বলা হয়।

বিপক্ষে যুক্তি:-

বাংলার নবজাগরণ প্রকৃত নবজাগরণ নয়: বাংলার নবজাগরণ কে অনেক ঐতিহাসিক স্বীকার করে নিলেও, অনেকে বলেছেন যে এটি একটি সত্যিকারের নবজাগরণ ছিল না। তাদের মতে –

তথাকথিত নবজাগরণ – অশোক মিত্র ১৯৫১ সালে আদমশুমারি বা Census তৈরির সময় বাংলায় উনিশ শতকের জাগরণকে “তথাকথিত নবজাগরণ” বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করেছিল সরকার, তার একটি অংশ কলকাতার সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে খরচ হয়েছিল এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনও যোগ ছিল না।

ঐতিহাসিক প্রতারণা – বিনয় ঘোষ তার ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে এই নবজাগরণকে ‘ঐতিহাসিক প্রতারণা’ আখ্যা দিয়ে বলেন – “নবজাগরণ হয়নি, যা লেখা হয়েছে এখনও লেখা হয়, তা অতিকথা মাত্র।” ডক্টর অরবিন্দ পোদ্দার এই নবজাগরণ কে “এক অসত্য নিরস ঘটনা” বলেছেন।

ইউরোপীয় নবজাগরণের সমতুল্য নয় – ড. অমলেশ ত্রিপাঠী মনে করেন দ্বাদশ ও ত্রয়াদেশ শতকের বাণিজ্য বিপ্লব, নগর বিপ্লব যেভাবে ইটালির নবজাগরণের পটভূমি প্রস্তুত করেছিল, বাংলার নবজাগরণের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় নি। ইটালির নবজাগরণের কেন্দ্র ফ্লোরেন্স ছিল স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশ। অপরদিকে, বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্র ছিল কলকাতা, যা ছিল ব্রিটিশ ইংরেজদের অধীনস্থ।

এছাড়াও গবেষক সুপ্রকাশ রায় বলেছেন – “বাংলায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল ইউরোপের আন্দোলন থেকে ভিন্ন ও বিপরীতমুখী”। তার মতে, আধুনিক যুগের লেখকগণ ইউরোপীয় নবজাগরণ আন্দোলন এর অনুকরণে বাংলার নগরকেন্দ্রিক আন্দোলনের নাম দিয়েছিলেন নবজাগরণ।

বাংলার নবজাগরণ এর সীমাবদ্ধতা :

১) এটি ছিল নগরকেন্দ্রিক নবজাগরণ। কলকাতা ছিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের ঔপনিবেশিক কেন্দ্ৰ।

২) কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীসহ এক বড় অংশের মানুষরা এই নবজাগরণে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।

৩) বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত উচ্চবর্ণ হিন্দুদের। মুসলিম সম্প্রদায় এতে অংশগ্রহণ করতে পারেনি বলে মনে করা হয় ।

৪) বাংলা নবজাগরণ এর পৃষ্ঠপোষকরা সমাজ কাঠামো, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করতে পারেনি।

মূল্যায়ন : সবমিলিয়ে নবজাগরণ ছিল এক বিপুল পরিবর্তনের ধারা, যা পরিলক্ষিত হয় সমাজ,দেশ ও কালের বিন্যাসে। এই নবজাগরণ এর ফলে শিক্ষার হার বৃদ্ধি, বিধবা বিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ বন্ধ, চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং কুসংস্কারের অন্তর্জাল থেকে বেরিয়ে মানুষের এক নতুন চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটে।

আরো পড়ুন

উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ রচনা করাে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment