ছাত্রজীবনে সৌজন্য ও শিষ্টাচার | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ছাত্রজীবনে সৌজন্য ও শিষ্টাচার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ছাত্রজীবনে সৌজন্য ও শিষ্টাচার

উত্তর:

ছাত্রজীবনে সৌজন্য ও শিষ্টাচার

মানুষ একসময়ে ছিল আদিম, বর্বর। তার জীবন কেটেছে গুহায় ও অরণ্যে। সভ্যতার সেই আদিলগ্নে বেঁচে থাকাটাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। তাই তার সমস্ত আচরণের মূলে ছিল প্রবৃত্তির তাড়না। শৃঙ্খলাহীন, সংযমহীন মানুষ স্বভাবের দিক থেকে তখন প্রায় পশুর কাছাকাছি ছিল। কিন্তু ক্ৰমে মানুষের স্বভাবে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একটু একটু করে তার মধ্যে বিকশিত হতে থাকে মানুষের প্রকৃত ধর্ম। ক্রমে সে হয়ে ওঠে সভ্য, সামাজিক। তার আচরণে দেখা দেয় সৌজন্য। সে শিষ্টাচারকে মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বলে উপলব্ধি করতে শেখে। সৌজন্য ও শিষ্টাচার মানবসভ্যতার একটি বিশিষ্ট লক্ষণ।

সৌজন্য ও শিষ্টাচার কথা দুটি প্রায় সমার্থক। দুটি শব্দের দ্বারাই এক মানুষের প্রতি আর-এক মানুষের সুভদ্র মার্জিত আচরণকে বােঝায়। তবু অনেক সময় দুটির মধ্যে একটি সুক্ষ্ম পার্থক্যরেখা টানা হয়ে থাকে। সৌজন্যের মধ্যে দিয়েই মার্জিতরুচি সহৃদয় ব্যক্তির চরিত্রধর্মের প্রকাশ ঘটে। এর মধ্যে বাধ্যবাধকতার কোনাে ব্যাপার নেই। সৌজন্যের সঙ্গে তাই আন্তরিকতার একটি বিশেষ যােগ আছে। আর শিষ্টাচার হল সামাজিক মানুষের অলিখিত কিছু আচরণবিধি। যে আচরণ অন্যের স্বার্থ বিঘ্নিত করে না বা অন্যের মনে কোনাে ক্ষোভের সৃষ্টি করে না, তাকেই সাধারণভাবে শিষ্ট আচরণ বলা হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি মানুষের কাছ থেকেই সমাজ শিষ্টাচার দাবি করে। এজন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে না হলেও কখনাে কখনাে মানুষকে শিষ্টাচার পালন করতে হয়। সুসভ্য মানুষের ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে এ দুয়েরই পরিচর্যা অত্যন্ত প্রয়ােজনীয়। সৌজন্য ও শিষ্টাচার আমাদের জীবনকে সুন্দর করে, মনুষ্যত্বকে গৌরবান্বিত করে। এর অভাবে প্রশ্রয় পায় আদিম বর্বরতা।

অত্যন্ত দুঃখের কথা, বর্তমান সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে সৌজন্য ও শিষ্টাচারের খুবই অবনতি ঘটেছে। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা যত বাড়ছে, ততই মানুষ হয়ে উঠছে সৌজন্য ও শিষ্টাচারবর্জিত। প্রবীণদের প্রতি নবীনদের আচরণে এই ব্যাপারটি বেশি করে চোখে পড়ে। একসময় বয়স্কদের প্রতি অল্পবয়সিদের যে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের ভাব ছিল, এখন তা অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে গেছে। এখন তরুণ প্রজন্ম অনায়াসে প্রবীণদের অবজ্ঞা ও অসম্মান করতে পারে। ছাত্রদের হাতে শিক্ষকের মর্যাদাহানির ঘটনা তাে এখন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে মানুষ বড়াে বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। রাস্তাঘাটে, ট্রেনে-বাসে, স্কুলে-কলেজে, অফিসে কিংবা অন্যত্র প্রতিনিয়তই লাঞ্ছিত হয়ে চলেছে সৌজন্য ও শিষ্টাচার। সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে পারস্পরিক কটুক্তিবৰ্ষণ ও কলহ আজ প্রায়শই প্রত্যক্ষ করা যায়। সবচেয়ে লজ্জার কথা, ভারতবর্ষের সংসদের সভাকক্ষও আজ শিষ্টাচারহীনতার পীঠস্থান হয়ে উঠেছে। সেখানে মাননীয় মন্ত্রী ও সাংসদগণের কেউ কেউ অনেক সময় বিতর্ককালে পরস্পরের প্রতি যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলেন, যেভাবে উত্তেজিত অবস্থায় পরস্পরকে আক্রমণ করতে উদ্যত হন, তাতে কোথাও সৌজন্য ও শিষ্টাচারের লেশমাত্র থাকে না।

সৌজন্য ও শিষ্টাচার পালনের অভ্যাস প্রতিটি মানুষের জীবনেই অপরিহার্য। তবু আজকের দিনে বিশেষভাবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সৌজন্য ও শিষ্টাচারের আনুশীলন অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় হয়ে উঠেছে। ছাত্রছাত্রীরাই দেশের ভবিষ্যৎ। আর ছাত্রজীবন হল মানবজীবনের প্রস্তুতিপর্ব, চরিত্রগঠনের উপযুক্ত সময়। নবীন শিক্ষার্থীদের মন এই সময় যে-কোনাে বিষয়কে খুব সহজে গ্রহণ করতে পারে। বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সঙ্গে তাদের যদি সৌজন্য ও শিষ্টাচার সম্পর্কে সচেতন করে তােলা হয় তাহলে নিশ্চয়ই তারা তা আয়ত্ত করতে পারবে। ছাত্রজীবনেই ভদ্রতাবােধ, বিনয়, শ্রদ্ধাবােধ প্রভৃতি গুণ চরিত্রে স্থান পেলে পরবর্তীকালে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবেও তাদের মধ্যে সেইসব গুণের প্রকাশ ঘটবে। কাজেই ভবিষ্যৎ সমাজকে সুন্দর করার জন্য ছাত্রজীবনে সৌজন্য ও শিষ্টাচার পালনের অভ্যাস গড়ে তােলার কোনাে বিকল্প নেই। শুধু ভবিষ্যতের কথা ভেবেই নয়, ছাত্রজীবনকে সুন্দর করে গড়ে তােলার জন্যও মার্জিত আচরণের অনুশীলন প্রয়ােজন। ছাত্রছাত্রীরা যদি তাদের সতীর্থ, শিক্ষকশিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীদের প্রতি আচরণে সৌজন্য ও শিষ্টাচার প্রদর্শন করে তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুশৃঙ্খল, স্বাস্থ্যকর এবং আনন্দময় পরিবেশ বজায় থাকবে।

শুধু আইনের কঠোরতা দিয়ে মানুষকে সৌজন্য ও শিষ্টাচার শেখানাে যায়। না, তার জন্য চাই অন্য ব্যবস্থা। প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। পুথিগত পাঠের সঙ্গে সঙ্গে সৌজন্য ও শিষ্টাচারের পাঠও যাতে ছাত্রছাত্রীরা পায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়িতে ছােটোবেলা থেকেই ছেলেমেয়েরা যাতে সদাচারের শিক্ষা পায়, সে বিষয়ে মা বাবা বা অন্য অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া দরকার। বিভিন্ন ক্লাব ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে, এককথায় ঘরে ও বাইরে, সমাজের সর্বস্তরে সৌজন্য ও শিষ্টাচারকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।

আজ আমাদের চারদিকে সৌজন্যহীনতা ও শিষ্টাচারহীনতা যেভাবে প্রকট হয়ে উঠছে, তাতে মানবসভ্যতাকে হয়তাে একদিন ভয়ংকর এক সংকটের মুখােমুখি হতে হবে। সুতরাং যে-কোনাে মূল্যেই হােক, এই পাশবিক প্রবণতাকে প্রতিরােধ করতে হবে। রূঢ় আচরণ ও অশালীনতা বর্বরতারই নামান্তর মাত্র। মানুষ বহুকষ্টে যে বর্বরতাকে অতিক্রম করে এসেছে, তাকে আবার প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যত্বকে অপমানিত করা।

আরো পড়ুন

দেশপ্রেম বনাম বিশ্বপ্রেম | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বিশ্ব উষ্ণায়ন | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

Read More »

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment