নিরক্ষরতা, দারিদ্র ও বেকারত্ব-এর পারস্পরিক সম্পর্ক আলােচনা কর Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) | 8 Marks
উত্তর:
নিরক্ষরতা, দারিদ্র ও বেকারত্ব : নিরক্ষরতা বা নিম্নমানের সাক্ষরতা ব্যক্তিমানুষের কাজকর্মের ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করে তােলে। বিশেষ কিছু কাজকর্মে নিরক্ষর ব্যক্তি অসমর্থ-অযােগ্য প্রতিপন্ন হয়। কিছু কিছু কাজে জটিল ধরনের চিন্তাভাবনা, গাণিতিক বিচক্ষণতা ও লেখাপড়ার সুদৃঢ় বনিয়াদ লাগে। সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াকর্মে নিরক্ষর ও অশিক্ষিত ব্যক্তি অযােগ্য প্রতিপন্ন হয়। স্বভাবতই গায়ে-গতরে কাজ ব্যতিরেকে নিরক্ষরদের কর্মনিযুক্তির আর কোনাে সুযােগ থাকে না।
নিরক্ষরতা ও রুজি-রােজগার : ব্যক্তিমানুষের রুজি-রােজগারের উপর নিরক্ষরতা-সাক্ষরতার সরাসরি প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাপী এ কথা সাধারণভাবে সত্য। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে অল্পবিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে সাধারণভাবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, নিরক্ষর বা অশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের রােজগার স্বাক্ষর বা শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের রােজগারের থেকে অনেক পরিমাণে কম। আয় বাড়ানাের সামর্থ্য অর্জনের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য আবশ্যক নূন্যতম সাক্ষরতাও তাদের থাকে
না। সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষা সূত্রে প্রতিপন্ন হয় যে, নিরক্ষর বা নিম্নমানের সাক্ষরতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আয় তাদের সমগ্র কর্মজীবনে বাড়ে না, একই থেকে যায়। অপরপক্ষে ভালােভাবে স্বাক্ষর-শিক্ষিত এবং গাণিতিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ সমগ্র কর্মজীবনে তাদের আয় দু-তিন গুণ বাড়িয়ে নেয়। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেনি। এমন সব ব্যক্তি ভালাে রােজগারের কাজ পায় না। তাই অভাব-অনটন বা দারিদ্রের আশঙ্কা থেকেই যায়।
নিরক্ষরতা ও দারিদ্র : নিরক্ষরতা ও দারিদ্রের মধ্যে নিকট সংযােগ বর্তমান। পৃথিবার যে সমস্যা দেশে ব্যাপক নিরক্ষরতা বর্তমান, সেই সমস্ত দেশে দারিদ্রও বেশি। বয়স্ক সাক্ষরতার হার এবং দারিদ্রের পরিমাপের মধ্যে এক তাৎপর্যপূর্ণ নেতিবাচক অনুবন্ধ বা আন্তঃসম্পর্ক বর্তমান। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত ভারতেও এ ধরনের পরিসংখ্যান পরিলক্ষিত হয়। ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের যে সমস্ত দেশে দারিদ্রের হার অধিক, সেই সমস্ত দেশে সাক্ষরতার হার কম হওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হিসাবে গুটিকয়েক দেশের কথা বলা হয়; যেমন ইসলামিক রিপাবলিক ইরান, মরক্কো এবং টিউনিসিয়া। এই তিনটি দেশে দারিদ্র অপেক্ষাকৃত কম এবং সাক্ষরতার হারও কম।
দারিদ্র-নিরক্ষরতা-দারিদ্র একটি অশুভ চক্র হিসাবে কাজ করে। এই চক্র ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা মুস্কিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির লক্ষ লক্ষ মানুষ বিদ্যালয়ে যেতে পারে না; কোনােক্রমে ভর্তি হলেও ক্লাস করতে পারে না। কারণ তারা গরিব। প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়ােজনপূরণের তাগিদে কাজ করতে তারা বাধ্য হয়। ক্ষুধার জ্বালা এবং দারিদ্র হল অসংখ্য মানুষের রাতদিনের দুর্ভাবনা।
নিরক্ষরতা ও বেকারত্ব : ‘আন্তর্জাতিক বয়স্ক শিক্ষা এবং দক্ষতা সমীক্ষা’ (IALSS – International Adult Literacy and Skills Survey) অনুযায়ী কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের থেকে বেকার ব্যক্তিদের সাক্ষরতার হার কম। নিরক্ষর বা কম-স্বাক্ষর ব্যক্তিবর্গের বেকার হওয়ার আশঙ্কাই অধিক। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে এই আশঙ্কা প্রায় অনুপস্থিত। বেকারত্ব এবং নিরক্ষরতার মধ্যে ইতিবাচক পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি সুবিদিত। চাকরি পাওয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় যােগ্যতা নিরক্ষরদের মধ্যে থাকে না; তারা বহু ও বিভিন্ন অযােগ্যতা, অসামর্থ্য ও অসুবিধার শিকার হয়।
নিরক্ষরতা বা নিম্নমানের সাক্ষরতা এবং বেকারত্ব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। নিচু ক্লাসেই স্কুলছুটদের শিক্ষাগত যােগ্যতা কম, তাই কর্মনিযুক্তির সুযােগ-সম্ভাবনাও কম। নিরক্ষরতা বা কম শিক্ষার কারণে কর্মনিয়ােগের সুযােগ-সম্ভাবনা হ্রাস পায়। অন্যান্যদের থেকে এদের বেকার থাকার আশঙ্কা দ্বিগুণ বেশি। সুযােগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে নিরক্ষরতা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিতদের চাকরি পছন্দের কোনাে সুযােগ থাকে না। শুধু তাই নয়, তাদের চাকরি যাওয়ার আশঙ্কাও অধিক। অশিক্ষিত বেকারদের একবার চাকরি গেলে পুনরায় চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই কম। কিন্তু শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এই আশঙ্কা থেকে মুক্ত।
নিরক্ষরতা, বেকারত্ব এবং দারিদ্র পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। এ সবের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও বহুমাত্রিক। নিরক্ষরতা বা অশিক্ষা ব্যক্তিমানুষকে অসুবিধাজনক অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেয়। তারফলে তাদের বেকার থাকার এবং দরিদ্র হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। স্বভাবতই তাদের বহু ও বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন। হতে হয়।
নিরক্ষর বা কম শিক্ষিত ব্যক্তিদের অপরের সাহায্য-সহযােগিতার উপর নির্ভর করতে হয়। এ রকম মানুষ কাজ পেলেও বেতন কম হয়, চাকরির নিরাপত্তা থাকে না এবং বাড়তি কোনাে সুযােগ-সুবিধা থাকে। না। কম রােজগারের এই সমস্ত ব্যক্তি অন্য কি কি সামাজিক সুযােগ-সুবিধা পেতে পারে, সে বিষয়ে তারা সংবাদ-তথ্য জানতে আগ্রহী হয়। কিন্তু সে সবও তারা সবসময় জানতে পারে না। কারণ সামাজিক সুযােগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য আবেদনপত্র পড়ার ও পূরণের যােগ্যতা তাদের থাকে না। অসুবিধাজনক অশুভ এই চক্রের ভিতরে একবার এসে পড়লে, তার থেকে বেরিয়ে আসা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। এই অশুভ চক্রের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ সবরকম উৎসাহ এবং নিজেদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য উদ্যোগ-আয়ােজন এবং সমর্থন-সক্রিয়তা আসে মাতাপিতার কাছ থেকে। মা-বাবা নিরক্ষর ও অশিক্ষিত হলে তাদের ছেলেমেয়েরাও নিরক্ষর-অশিক্ষিত হয়। তারফলে এই অশুভ চক্রটি আবর্তিত হতে থাকে।
নিরক্ষরতা-অশিক্ষা এবং দারিদ্র ব্যক্তিবর্গের শরীর-স্বাস্থ্যের উপর প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। নিরক্ষর এবং কমআয়ের মানুষজন দুর্ভাবনা-দুশ্চিন্তায় দিন কাটায়। এমনকী তারা হিংসাত্মক কাজকর্মেরও শামিল হয়ে পড়তে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের আয় কম হলে কাজে উন্নতি বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যাপারে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। তারা ছেলেমেয়েদের প্রতিপালনে প্রয়ােজনীয় পরিচর্যা প্রদান করতে পারে না।
উপসংহার : উপরিউক্ত অশুভ চক্রের অভিশাপ থেকে হতভাগ্য ব্যক্তিবর্গকে মুক্ত করা আবশ্যক। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার সাহায্যেই এই সমস্ত মানুষজনের জীবনের দুর্দিনের অবসান ঘটানাে সম্ভব। তারজন্য সামগ্রিক বা সমষ্টিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা দরকার। অন্যথায় প্রাপ্ত সুফল সীমাবদ্ধ হবে। সামাজিক ও আর্থনীতিক ন্যায়কে সুনিশ্চিত করার জন্য বৃহত্তরভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। বহু ও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও অসুবিধার শিকার ব্যক্তিবর্গ ও পরিবারসমূহের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে বৃহত্তর পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট সামাজিক সংস্থাসমূহকে একযােগে সদর্থক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।