ভারতবর্ষের নারী আন্দোলন সম্পর্কে আলােচনা কর। উল্লেখযােগ্য কয়েকটি নারী আন্দোলন সমূহ বর্ণনা কর। Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) | 8 Marks
উত্তর:
নারী আন্দোলন | নীরা দেশাই-এর অভিমত অনুযায়ী মহিলাদের স্বাধীনতা ও সাম্যের সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যে সংগঠিত উদ্যোগই হল নারী-আন্দোলন। নারীজাতির জীবনকে প্রতিকূলভাবে।
প্রভাবিত করে, এ রকম যে-কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি নারী-আন্দোলন অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর। স্বাধীন ভারতে আইন, রাজনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীজাতির অবস্থান ও মর্যাদাগত মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকেই ভারতে সামাজিক সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত হয়। এই সমস্ত আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয় হিসাবে নারীজাতির অবস্থার উন্নয়নের কর্মসূচী অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ প্রসঙ্গে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রাজা রামমােহন রায়ের আপােশহীন সংগ্রাম স্মরণীয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় মহিলাদের সদর্থক উদ্যোগ-আয়ােজনের অবদান অনস্বীকার্য।
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর মহিলাদের আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্যের স্বীকৃতির। উপর জোর দেওয়া হয়। মহিলাদের ভােটাধিকার স্বীকার করা হয়। স্বাধীন ভারতের আইনমন্ত্রী আমবেরের নেতৃত্বাধীন কমিটি একটি বিল পেশ করে। এই বিলে বিবাহের বয়স বৃদ্ধি, একগামিতা, মহিলাদের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, উত্তরাধিকার ও খােরপােশের অধিকার, মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার, পণকে স্ত্রীধন হিসাবে স্বীকার প্রভৃতি প্রস্তাব করা হয়। সমকালীন সমাজের রক্ষণশীল অংশ এবং রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখ কংগ্রেসের কিছু প্রবীণ নেতা বিলটির বিরােধিতা করেন। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, সমাজসংস্কারকরা এবং নারী-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা বিলটিকে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেন। কিন্তু বিলটি স্থগিত হয়ে যায়। তার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট বিলটির অন্তর্ভুক্ত কতকগুলি বিষয়কে নিয়ে চারটি পৃথক আইন প্রণীত হয়। এই আইনগুলি হল : ‘হিন্দু বিবাহ আইন’, ‘হিন্দু উত্তরাধিকার আইন’, ‘হিন্দু নাবালক ও অভিভাবক আইন’, ‘হিন্দু দত্তক ও খােরপােশ আইন।
জাতীয় আন্দোলনের বিভিন্ন রাজনীতিক শক্তিসমূহ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর যে যার পথে চলতে শুরু করে। এই সময় নারী-আন্দোলনও বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৫৪ সালে বামপন্থী মহিলা সদস্যরা ‘সারা ভারত মহিলা সম্মেলন’ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং ভারতীয় মহিলাদের জাতীয় ফেডারেশন’ নামে সংস্থাটি। মহিলাদের একটি বৃহত্তর মঞে পরিণত হওয়ার পরিবর্তে একটি দলীয় সংখ্যায় পরিণত হয়। ভারতের। সমকালীন নেত্রীদের অনেকেই নারী-কল্যাণমূলক বিবিধ কর্মসূচী রূপায়ণের জন্য সরকার পরিচালিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠিনিক প্রকল্পের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েন। এই সমস্ত কর্মসূচীর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল মর্মান্তিক উদ্বাস্তু সমস্যার মুখে বিপন্ন উদ্বাস্তু মহিলাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, শহরাঞ্চলে কর্মরত মহিলাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা, মহিলাদের জন্য কর্মপ্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।
বিংশ শতাব্দীর পাশের ও ষাটের দশকে উল্লেখযােগ্য কোনাে নারী-আন্দোলনের পরিচয় পাওয়া যায় । এই কারণে অনেকে এমন কথাও বলেন যে, স্বাধীনতালাভের পর এবং সত্তরের দশকে নতুন উদ্যোগআয়ােজন গৃহীত হওয়ার আগে অবধি নারী-আন্দোলন কার্যত স্তিমিত ছিল। পরবর্তকিালে নারী-আন্দোলন জোরদার হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর শেষের তিনটি দশকে নারী-আন্দোলনের বিশেষ পরিবর্তনসাধিত হয়। অনেকের অভিমত অনুসারে সত্তরের দশকটি হল নারী-আন্দোলনের পুনর্জাগরণের পর্ব। এই সময় ক্রমান্বয়ে নারী-আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কখনাে একেবারে স্থানীয় পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, কখনাে ক্রমবর্ধমান জাতীয় সংকটের মুখে, আবার কখনাে আন্তর্জাতিক নারী-আন্দোলনের অংশ হিসাবে নারী-আন্দোলন সংগঠিত হয়। নারীআন্দোলনের এই পটভূমিগত বৈচিত্র্যের কারণে আন্দোলনের মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শগত সংঘাত, বিচ্ছিন্নতা এবং আঞ্চলিকভাবে আন্দোলনের অসম বিকাশ পরিলক্ষিত হয়।
নব্বইয়ের দশকে রাজনীতিক ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের দ্রুত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এই সময় নারী-আন্দোলনের সঙ্গে বিভ্রান্তিমূলক ও ত্বরিত অবস্থার উপাদান সংযুক্ত হয়। এই সময় পর্যন্ত আন্দোলন নিস্তেজ হয়ে পড়েনি। কারণ হিসাবে বলা যায় যে, তৃণমূল স্তরে ব্যাপকভাবে মহিলাদের মধ্যে আন্দোলনের ভিত্তিভূমি গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া ইতিমধ্যে নারী-আন্দোলন ব্যাপক উদ্দেশ্যযুক্ত ও অপেক্ষাকৃত স্থায়ী প্রকৃতির হয়েছিল। নির্দিষ্ট কোনাে দাবির মধ্যে আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল না। তবে আন্দোলনের মূল বরাবরই গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের মধ্যেই নিহিত ছিল। নারীজাতির গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের উপরই সবসময় সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে বড় বিষয় হিসাবে নারীআন্দোলনের সঙ্গে হিংসা ক্রমান্বয়ে অধিকমাত্রায় সংযুক্ত হতে থাকে।
উল্লেখযােগ্য আন্দোলনসমূহ : বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে এবং সত্তরের দশকের গােড়ার দিকে ভারতে এক নতুন রাজনীতিক আবহাওয়া ও প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই সময় কিছ নতুন ধরনের রাজনীতিক আন্দোলন সংগঠিত হতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন, চিপকো আন্দোলন, মূলবৃদ্ধি বিরােধী আন্দোলন প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। এই সমস্ত আন্দোলনের কোনােটিকেই সরাসরি নারী-আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু ব্যাপক সংখ্যায় মহিলাদের অংশগ্রহণের কারণে সংশ্লিষ্ট আন্দোলনসমূহ স্বতন্ত্র মাত্রা লাভ করেছিল এবং মহিলাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস দেখা দিয়েছিল ও স্বাধীনতাসূচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯৭৩-৭৫ সালে মহারাষ্ট্রের শহরাঞ্চলে কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রী মহিলারা মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠিত করেন। হাজারে হাজারে গৃহবধূ প্রকাশ্য মিছিলে যােগ দেন। যাঁরা ঘর ছেড়ে মিছিলের সামিল হতে পারেননি, তাঁরা থালা বাজিয়ে সমর্থন জানান।
সত্তরের দশকে নারী-আন্দোলনের আর একটি ধারা পরিলক্ষিত হয়। এই ধারাটি মহিলাদের স্বশাসনিক গােষ্ঠী বা স্বশাসনিক সংগঠন (Autonomous Women’s Organization) হিসাবে চিহ্নিত হয়। স্বশাসনিক মহিলা সংগঠন বলতে সেই সমস্ত সংগঠনকে বােঝায় যেগুলি কোনাে রাজনীতিক দলের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি মহিলাদের এরকম স্বশাসনিক গােষ্ঠী শহরাঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠে। এ রকম গােষ্ঠীসমূহের অন্তর্ভুক্ত মহিলাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁরা মাওবাদী বা নকশালপন্থী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন বা এ ধরনের আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
১৯৭২ সালে মহারাষ্ট্রের ধুলিয়া জেলার শাহাদা উপাজতি অধ্যুষিত অঞ্চলে উপজাতীয় রমণীদের মদ্যপান-বিরােধী এক আন্দোলন সংগঠিত করতে দেখা যায়। এই আন্দোলন প্রাথমিক পর্যায়ে পরিচালিত। হয়েছে গান্ধীবাদী সর্বোদয় কর্মীদের দ্বারা এবং পরবর্তীকালে মাওবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের দ্বারা।
১৯৭৪ সালে উত্তরপ্রদেশের উত্তরাখণ্ডের চিপকো আন্দোলন নারী-আন্দোলনের আর একটি বড় উদাহরণ। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে কাঠ ব্যবসায়ীরা নির্বিচারে গাছ কেটে বনাঞ্চল ধ্বংসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মহিলারা বনাঞ্চল সংরক্ষণের ব্যাপারে সংগঠিতভাবে এগিয়ে আসে।
১৯৭৭ সালের জরুরি অবস্থার পর নারী-আন্দোলনের ক্ষেত্রে আর একধরনের উদ্যোগ-আয়ােজন পরিলক্ষিত হয়। দিল্লির মহিলাদের একটি গােষ্ঠী নারী-আন্দোলনের অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। মানুষী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা হয়। নারী-আন্দোলন সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যাদি, তথ্যাদির পর্যালােচনা প্রভৃতি নিয়মিতভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা হয়।
১৯৭৭ সালে মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড়ের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় ছত্রিশগড় খনিশ্রমিক সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের যান্ত্রিকীকরণের কর্মসূচীর বিরুদ্ধে জঙ্গী আন্দোলন সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
১৯৭১ সালে বিহারে ‘ছাত্র যুব সংঘর্ষ বাহিনী গঠিত হয়। বিহারের বুদ্ধগয়ায় মন্দিরের পুরােহিতদের বিরুদ্ধে ক্ষেতমজুরদের স্বার্থ সংরক্ষণমূলক আন্দোলনকে মদত দেওয়ার জন্য এই বাহিনী সক্রিয় হয়। পণপ্রথা ও পণ-মৃত্যু প্রভৃতির বিরুদ্ধে মহিলাদের সংগ্রাম ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
১৯৭৯ সাল থেকে পণব্যবস্থা সম্পর্কিত নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠিত হয়। জনতা পার্টির মহিলারা মহিলা দক্ষতা-সমিতি গঠন করেন। এই সমস্ত মহিলাদের অধিকাংশই সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। তারা পণবিরােধী আন্দোলনের আয়ােজন করেন।
আশির দশকের মাঝামাঝি মহারাষ্ট্রে শ্বেতকারী সংগঠনের মহিলা শাখা হিসাবে ‘সমগ্র মহিলা অঘাদি’-র আবির্ভাব ঘটে। ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে এই মহিলা সংগঠনটির একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৮৪ সালে ইউনিয়ন কারবাইড কারখানায় রাসায়নিক বিষাক্ত গ্যাস লিক হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন বহু মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গত মানুষগুলির জন্য ন্যায়বিচারকে নিশ্চিত করার জন্য মহিলারা আন্দোলন সংগঠিত করেন। এক্ষেত্রে ভূপাল গ্যাস পিড়িত মহিলা উদ্যোগ সংগঠন’ সদর্থক ভূমিকা পালন করে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।