লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি সংক্ষেপে আলােচনা করাে
উত্তর :
লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি :
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে দুটি পরস্পর বিরােধী ধারা গড়ে উঠেছিল। এই সময় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি এই শিক্ষার বিরুদ্ধে বিদোহী জনমত তৈরি হয়েছিল। এই রকম ঐতিহাসিক পটভূমিকায় 1998 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বড়ােলাট হয়ে ভারতবর্ষে আসেন। তার শিক্ষা পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীর মনে উদ্ভুত নব্য জাতীয়তাবােধকে ধ্বংস করা এবং এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে আরও বেশি মজবুত করা। তিনি 1901 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সিমলাতে এক শিক্ষা সম্মেলন আহ্বান করেন। ওই সম্মেলনে 150টি প্রস্তাবসহ শিক্ষানীতি প্রস্তুত হয়। এরপর তিনি 1902 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন করেন এবং 1904 খ্রিস্টাব্দের 11 মার্চ একটি সরকারি সিদ্ধান্ত আকারে তার শিক্ষানীতি প্রকাশ করেন। তার শিক্ষানীতিটি ‘Government of India’s Resolution of Education Policy-1904′ নামে পরিচিত।
প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে কার্জনের নীতি :
(i) শিক্ষার জন্য বরাদ্দ অর্থের বেশিরভাগটাই প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যয় করতে হবে।
(ii) পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে যে-নীতি প্রচলিত ছিল, তা বন্ধ করতে হবে।
(iii) মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
(iv) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
(v) প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমের পরিবর্তন সাধন করতে হবে এবং প্রকৃতিপাঠ, কৃষিবিদ্যা, শারীরশিক্ষাকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
(vi) প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণগত ও গুণগত মানােন্নয়নের বিষয়ে সরকারকে আরও বেশি সচেষ্ট হতে হবে।
মাধ্যমিক শিক্ষা বিষয়ে কার্জনের নীতি :
(i) অনুমােদিত সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিকে সরকারি অর্থভাণ্ডার থেকে প্রয়ােজনীয় আর্থিক অনুদান বরাদ্দ করা হবে।
(ii) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানাের জন্য শিক্ষক-শিক্ষণ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ঘটাতে হবে।
(iii) মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রমকে সময়ােপযােগী ও বাস্তবধর্মী করে তুলতে হবে।
(iv) মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। তবে শিক্ষার্থীরা যাতে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে, সেজন্য ইংরেজি অনুশীলনের ব্যবস্থা থাকবে।
(v) মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে পরিদর্শন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
(vi) কিছু সংখ্যক মডেল স্কুল স্থাপন করতে হবে।
(vii) বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়াতে হবে।
উচ্চশিক্ষা বিষয়ে কার্জনের নীতি :
(i) বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্নাতকোত্তর স্তরের পঠনপাঠন ও গবেষণার ব্যবস্থা করতে হবে।
(ii) বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-এর সদস্য সংখ্যা 50 থেকে 100-এর মধ্যে এবং সিন্ডিকেটের সদস্য সংখ্যা 3 থেকে 15-এর মধ্যে রাখা দরকার।
(iii) মহাবিদ্যালয়গুলির শিক্ষার মানােন্নয়নের জন্য পরিদর্শন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
(iv) প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌগােলিক সীমা নির্ধারণের দায়িত্ব সপার্ষদ গভর্নর জেনারেলের ওপর অর্পণ করতে হবে।
বৃত্তিশিক্ষা বিষয়ে কার্জনের নীতি :
(i) সাধারণ শিক্ষা ছাড়াও শিক্ষার্থীরা যাতে বৃত্তিশিক্ষার সুযােগ পায়, তার জন্য বৃত্তিশিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে।
(ii) এদেশে কৃষির উন্নয়নের জন্য কৃষিশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
(iii) বৃত্তিশিক্ষার পাঠক্রম যাতে স্থানীয় চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
নারীশিক্ষা বিষয়ে কার্জনের নীতি :
(i) নারীশিক্ষার বিকাশের জন্য অধিক সংখ্যক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
(ii) শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণের জন্য মহিলা শিক্ষক-শিক্ষণ মহাবিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
(iii) নারীশিক্ষার বিকাশের জন্য আলাদা করে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
মুল্যায়ন : কার্জনের শিক্ষানীতি পর্যালােচনা করলে তার শিক্ষানীতির বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। এগুলি হল—
(1) শিক্ষার গুণগত সাফল্যের প্রতি গুরুত্ব আরােপ;
(ii) বাণিজ্য, কৃষি, চিকিৎসা, কারিগরি প্রভৃতি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বদান;
(iii) মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বহুমুখী পাঠক্রমের প্রবর্তন;
(iv) বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পঠনপাঠনের পাশাপাশি গবেষণার সুযােগ সৃষ্টি;
(v) প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও উন্নয়ন; এবং
(vi) শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা চালু করা ইত্যাদি।
এই বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে বলা যায় লর্ড কার্জন একজন শিক্ষা-সংস্কারক।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।