সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
উত্তর:
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা
যেসব সামাজিক সমস্যা মানবসভ্যতাকে আজও কলঙ্কিত করে, সাম্প্রদায়িকতা তার অন্যতম। মানুষের মধ্যে ভাষা, জাতি, ধর্ম প্রভৃতির ভিত্তিতে ভিন্নতা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভিন্নতার ভিত্তিতে কখনােই একে অপরের শত্রু হয়ে ওঠা উচিত নয়। অথচ বাস্তবে সেরকমটাই ঘটতে দেখা যায়। এক সম্প্রদায়ের কাছে অন্য সম্প্রদায় হয়ে ওঠে বিদ্বেষ ও ঘূণার পাত্র। একের প্রতি অপরের অবিশ্বাস, অবজ্ঞা আর অসহিষ্ণুতায় বিষিয়ে ওঠে পারস্পরিক সম্পর্ক। সাম্প্রদায়িক কলহ ও সংঘর্ষে দুষিত হয়ে ওঠে সমাজ তথা সমগ্র মানবসভ্যতা।
বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িকতা এক ভয়ংকর সমস্যারূপে দেখা দিয়েছে। এখনও এর অভিশাপ থেকে মানুষ মুক্তি পায়নি। বরং দিকে দিকে এই সমস্যা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছে। কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে, কোথাও ভাষার ভিত্তিতে, কোথাও বা জাতি-পরিচয়কে কেন্দ্র করে সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ প্রকট হয়ে উঠছে। ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার উগ্র মূর্তি প্রায়শই ঘনিয়ে তুলছে আশকার ছায়া। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে তাে বটেই, অন্যান্য দিক থেকেও সাম্প্রদায়িকতার বিষে ভারতবর্ষ আজ কলুষিত। কখনও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে প্রাদেশিক সংকীর্ণতা, কখনও লড়াই বাধছে এক ভাষাগােষ্ঠীর সঙ্গে আর এক ভাষাগােষ্ঠীর।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষুন্ন হওয়ার নেপথ্যে আছে বিভিন্ন কারণ। সাধারণভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অসহিষতা থেকেই এর উৎপত্তি। অন্যের থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করার ঘূণ্য মানসিকতা থেকেই মূলত এই অসহিষ্ণুতার জন্ম। কোনাে বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়, জাতি বা ভাষাগােষ্ঠী যখন অপরকে নিজের থেকে নিকৃষ্ট মনে করে, অপরের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়, তখনই দেখা দেয় বিরােধ। এই সংকীর্ণ মানসিকতাকে উসকে দেয় ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতারা। ধর্মাচরণের লক্ষ্য যেখানে মঙ্গল ও কল্যাণ, সেখানে প্রকৃত ধর্মবােধহীন কিছু কিছু ধর্মীয় নেতা নিজের নিজের ধর্মসম্প্রদায়কে অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্ররােচিত করে। ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ তখন হয়ে ওঠে ধর্মান্ধ, আক্রমণাত্মক। রাজনৈতিক নেতারা সাম্প্রদায়িকতাকে সম্বল করে বহুক্ষেত্রেই স্বার্থসিদ্ধির পথ পরিষ্কার করার চেষ্টা করে। ইংরেজরা একসময়ে হিন্দু-মুসলমানের বিরােধকে ভারতবর্ষ শাসনের অন্যতম উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছিল। স্বাধীনতার পরে ইংরেজরা নেই, কিন্তু আজও এদেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়ে চলেছে।
সাম্প্রদায়িকতার পরিণাম যে কত মারাত্মক হতে পারে, ইতিহাসে বারবার তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, হিটলারের ইহুদি নিধন এবং কৃয়াঙ্গদের উপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের কথা। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ পরিণতির দৃষ্টান্ত প্রচুর। স্বাধীনতার আগে এবং পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় কত মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এখনও রামমন্দির ও বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে মাঝে মাঝেই উত্তাল হয়ে উঠছে সমস্ত দেশ। এ ছাড়া উল্লেখ করা যেতে পারে, পাঞ্জাবের খালিস্তানি আন্দোলন, দার্জিলিঙের গােখা আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়খণ্ডি আন্দোলন, অসম থেকে বিদেশি বিতাড়ন প্রভৃতির কথা। এসবই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির প্রকারভেদ মাত্র। এসবের মধ্যে দিয়ে ঘটেছে বহু রক্তপাত, বিপন্ন হচ্ছে জাতীয় সংহতি।
সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরােধ করার দায়িত্ব দেশের প্রতিটি মানুষের। তবু এ বিষয়ে ছাত্র সম্প্রদায়ের ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ছাত্রছাত্রীরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। তারা সংঘবদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে দেশের মাটি থেকে এই বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটিত করা অসম্ভব নয়। স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতিধর্ম নির্বিশেষে বহ ছাত্রছাত্রীর সমাবেশ ঘটে। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক। নিজেদের মধ্যে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টানের ভেদাভেদ তাদের কাছে কোনাে গুরুত্বই পায় না। সুতরাং, ছাত্রজীবনের এই দৃষ্টান্তকে খুব সহজেই তারা বৃহত্তর জনসমাজে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে পারে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ যদি জনমত গঠনের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তাহলে নিঃসন্দেহে সুফল পাওয়া যাবে। এর জন্য কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকলে চলবে না। যেতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। মানুষের অন্ধ বিশ্বাস এবং সংকীর্ণতা দুর করার জন্য নানাভাবে উদ্যোগী হতে হবে। দেশের ঐতিহ্য এবং সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিত করার দায়িত্ব নিতে হবে ছাত্রসমাজকে। এর জন্য তারা বিভিন্ন জায়গায় আলােচনা সভা ও বক্তৃতার ব্যবস্থা করতে পারে, ব্যবস্থা করতে পারে প্রদর্শনীর। দলবদ্ধভাবে বেরােতে পারে প্রচার অভিযানেও।
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ আজ অভাবনীয় উন্নতি করেছে। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, দর্শন প্রভৃতিতে তার সমৃদ্ধি ঘটেছে প্রচুর। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, মানুষ আজও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। এখনও সাম্প্রদায়িক বিষয়কে কেন্দ্র করে অসহিষ্ণু অন্ধ আবেগে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, এখনও তার ভদ্র আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসে বর্বরতা। মনুষ্যত্বের এই নিদারুণ অপমান নীরবে সহ্য করাও অন্যায়। তাই ছাত্রসমাজকে শুধুমাত্র অধ্যয়নে নিবিষ্ট না থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। উদ্ধার করতে হবে মনুষ্যত্বকে।
আরো পড়ুন
দেশপ্রেম বনাম বিশ্বপ্রেম | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
ছাত্রজীবনে সৌজন্য ও শিষ্টাচার | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিশ্ব উষ্ণায়ন | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।