মহিলাদের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে লেখ

মহিলাদের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে লেখ | ভারতীয় সমাজে মহিলাদের মর্যাদাগত অবস্থানের পরিবর্তন সম্পর্কে লেখ। Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) | 8 Marks

উত্তর:

সাংবিধানিক ও অন্যান্য অধিকার : স্বাধীন ভারতের সংবিধানে নারীজতির বিবিধ অধিকার। স্বীকার করা হয়েছে। সাম্য ও স্বাধীনতার অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার, সম্পত্তির, শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের এবং শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার সংবিধানে স্বীকার করা হয়েছে। মহিলাদের স্বতন্ত্র স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকারও বহু ও বিভিন্ন বিশেষ আইনপ্রণয়ন করেছে এবং করে চলেছে। সামাজিক, অর্থনীতিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের স্বার্থ সম্পর্কিত অনেক সরকারি আইন ইতিমধ্যে প্রণীত হয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রে বিবাহ, দত্তকগ্রহণ ও গর্ভপাতের বিষয়ে আইন প্রণীত হয়েছে। বিবাহব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে মহিলাদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কলকারখানায় কাজের পরিবেশ, অভিন্ন কাজের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমমজুরি, কাজের বা চাকরির নিরাপত্তা, মাতৃমঙ্গল, সম্পত্তির অধিকার, উত্তরাধিকার প্রভৃতি আর্থনীতিক বিষয়াদিতে মহিলাদের স্বার্থ সংরক্ষণমূলক আইন প্রণীত হয়েছে। রাজনীতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের নির্বাচন করার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার স্বীকার করে আইন প্রণীত হয়েছে।

ভারতীয় সমাজে মহিলাদের মর্যাদাগত অবস্থানের পরিবর্তন

সাংগঠনিক ও জীবনধারাগত ক্ষেত্রে পরিবর্তন : ভারতে নারীমুক্তি বা নারীজাতির স্বার্থ সংরক্ষণমূলক বিবিধ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। এই সমস্ত নারী-আন্দোলনের আবেদনে সাড়া দিয়ে সরকারও বিভিন্ন সহায়ক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে। তারফলে সাংগঠনিক ও জীবনধারাগত ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন। সাধিত হয়েছে। এই সমস্ত পরিবর্তনের সুবাদে শিক্ষা, চাকরি, রাজনীতিক অংশগ্রহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য সমানাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। আবার ইতিমধ্যে সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলা সংগঠনসমূহের সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্ত সংগঠন মহিলাদের স্বার্থ ও সমস্যাদি সম্পর্কে সদর্থক ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। উল্লিখিত ও আনুষঙ্গিক পরিবর্তনসমূহের সুবাদে নারীজাতির উপর শােষণ-পীড়ন ও অবদমনমূলক সমস্যাদির অনেকাংশে সুরাহা হয়েছে। বাস্তবে এখনও মহিলাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার শিকার হতে হয়। মহিলারা এখনও অনেক ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত।

প্রগতিমূলক পরিবর্তন: আধুনিক ভারতের সমাজব্যবস্থায় মহিলাদের মর্যাদাগত অবস্থান আগের। মত অতটা আপত্তিকর বা হতাশজনক নয়। পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের প্রগতিমূলক পরিবর্তন ঘটেছে। সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলাদের মর্যাদাগত অবস্থানের উল্লেখযােগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় মহিলাদের সামাজিক এবং আইনগত অধিকারের পরিধি প্রসারিত হয়েছে। মহিলারা এখন অনেক বেশি অধিকারভােগ করেন। তাদের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

মহিলাদের বাসস্থান ও শ্রেণীগত পার্থক্য : গ্রামাঞ্চলে কর্মরত ও কর্মহীন মহিলাদের মর্যাদার। ক্ষেত্রে তেমন একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। শহরাঞ্চলের অধিবাসী মহিলাদের মধ্যে শ্রেণিগত পার্থক্য বিশেষভাবে চোখে পড়ে। সম্পদশালী শ্রেণির এবং দরিদ্র শ্রেণির মহিলাদের মধ্যে জীবনধারাগত স্বাতন্ত্র অনস্বীকার্য। এই দুই শ্রেণির মহিলাদের নিজস্ব ধরনের জীবনধারা আছে। অপরদিকে মধ্যবর্তী শ্রেণির মহিলাদের জীবনধারাগত অবস্থান উপরিউক্ত দুটি ধারার সংযােগস্থলে। মধ্যবর্তী শ্রেণির মহিলাদের স্বতন্ত্র মূল্যবােধ ও দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান। ভারতের মহিলাদের মর্যাদাগত অবস্থান বিচার-বিবেচনা করার আগে গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলের মহিলাদের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে শহরাঞ্চলের মহিলাদের মধ্যে আরও তিনটি শ্রেণিবিভাগ করতে হবে। এই তিনটি শ্রেণিবিভাগ হল : বিত্তবান, বিত্তহীন ও মধ্যবর্তী শ্রেণি।

মর্যাদাগত অবস্থানের উন্নতির সূচক : সাম্প্রতিককালের সমাজব্যবস্থায় মহিলাদের মর্যাদাগত অবস্থানের উল্লেখযােগ্য উন্নতি ঘটেছে। নারীজাতির মধ্যে সর্বস্তরে শিক্ষার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্রীদের সংখ্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের উন্নতি ঘটেছে। ভারতের বিভিন্ন আইনসভায় এবং অন্যান্য রাজনীতিক পদসমূহে মহিলাদের সংখ্যা উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদনমূলক এবং পরিচালনামূলক কাজকর্মেও মহিলারা এখন আর পিছিয়ে নেই। এ ছাড়া এ প্রসঙ্গে আরও কতকগুলি আনুষঙ্গিক বিষয়ের

উল্লেখ করা আবশ্যক। বর্তমানে বিবাহ-বিচ্ছেদের সংখ্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পুরুষ আবেদনকারীর থেকে মহিলা আবেদনকারীর সংখ্যা অধিক। নারী নির্যাতন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক অপরাধের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। অসবর্ণ বিবাহের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

মহিলাদের সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধি : আধুনিক ভারতের সমাজব্যবস্থায় সাবেকী মূল্যবােধসমূহ। অনেকাংশে অপসারিত হয়েছে। বর্তমানে সাম্য, স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, যুক্তিবাদ প্রভৃতি আধুনিক মূল্যবােধসমূহের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালের সমাজজীবনে মহিলারা নিজেদের একটি অবস্থান অর্জন করেছে। পরিবার পরিচালনার উপর পুরুষের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। কর্মক্ষেত্রের মত পরিবারের মধ্যেও মহিলাদের সুযােগ-সুবিধার পরিধি প্রসারিত হয়েছে।

পাত্রী হিসাবে উপার্জনশীল মেয়ের গুরুত্ব বৃদ্ধি : সনাতন বিবাহব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক তাৎপর্য ও মর্যাদা অধুনা অনেকাংশে অপসারিত হয়েছে। পাত্র-পাত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সাবেকি সামাজিক নিয়ম-নিষেধ সাম্প্রতিককালে শিথিল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সুশিক্ষিতা, চাকুরিরতা বা উপার্জনশীল রমণীকে বধূ হিসাবে বরণ করার ব্যাপারে পাত্রদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। মেয়েদের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে। চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে মেয়েরা এখন পুরুষদের সঙ্গে একরকম সমানতালে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে। কোনাে চাকরির ক্ষেত্রেই এখন পুরুষের পূর্বেকার একাধিপত্য আর নেই। আধুনিককালের সমাজব্যবস্থায় কর্মরত বা উপার্জনশীল দম্পতিদের স্বতন্ত্র মান-মর্যাদাযুক্ত দেখা যায়। এখন তাই পাত্র-পাত্রীদের বেশী বয়সে বিবাহ করতে দেখা যায়।

গৃহকর্মে সদাব্যস্ত নয় : আগেকার যৌথ পরিবারসমূহ ভেঙ্গে পড়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মহিলাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের সাবেকী ধারার পরিবর্তন ঘটেছে। এই শ্রেণির মহিলারা এখন গার্হস্থ্য জীবনের কাজকর্মে বা সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব সম্পাদনে সর্বক্ষণ নিযুক্ত বা ব্যস্ত থাকেন না। এঁরা সম্পত্তিবান শ্রেণির পর্যায়ে নিজেদের উপনীত করার ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন।

উৎপাদনমূলক কাজকর্মে মহিলাদের উদ্যোগ-আয়ােজন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পকলা প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই বর্তমানে মহিলাদের অবাধ বিচরণ। পুরুষের একাধিপত্যের ক্ষেত্র এখন আর নেই।

রাজনীতিক ক্ষেত্রেও মহিলাদের অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। সংসদে, বিধানসভায়, পৌর প্রতিষ্ঠানসমূহে এবং পায়েত প্রতিষ্ঠানসমূহে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পঞ্চায়েত পর্যায়ে আইন করে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

গ্রামাঞ্চলের অধিবাসী মহিলারা এখনও অনেকাংশ ঐতিহ্যবাদী। সাবেকী সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের উপর তারা গভীরভাবে আস্থাশীল। এবং জীবনধারাগত ক্ষেত্রসমূহে তারা সাধারণত রক্ষণশীল। কিন্তু। শহরাঞ্চলের মহিলারা রক্ষণশীলতা ও সাবেকীয়ানার বিরুদ্ধে সংস্কারবাদী ভূমিকায় সক্রিয়।

তবে শহরাঞ্চলের সকল শ্রেণির মহিলারাই সমভাবে প্রগতিশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ, এমন কথা বলা যায় না। নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মহিলাদের জীবনধারাগত পরিস্থিতির তেমন একটা পরিবর্তন ঘটেনি। এখনও তারা অনেকাংশে ঐতিহ্যবাদী জীবনযাপন করে থাকেন। এখনও সমাজব্যবস্থায় তাদের অবস্থান অবদমিত। সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক অবস্থানগত বিচারে এই মহিলারা পুরুষের সমপর্যায়ভুক্ত নন। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতার কারণে এখনও এঁরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার শিকার হন।

পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার নিয়ম-নিষেধের নিয়ন্ত্রণমূলক নিগড় থেকে নারীজাতির একটা উল্লেখযােগ্য অংশ এখনও মুক্ত নয়। মহিলাদের একটা বড় অংশকে এখনও অনেকাংশে ঐতিহ্যবাদী জীবনধারা অনুসরণ করতে হয়।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment