বংশগতি এবং পরিবেশ বলতে কী বােঝ | শিক্ষার্থী হল বংশগতি ও পরিবেশের আন্তঃক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়ার গুণফল — এই উক্তিটি ব্যাখ্যা করাে।
উত্তর :
বংশগতি :
জীববিজ্ঞানীদের মতে, একটি শিশু যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তার পিতা-মাতার কাছ থেকে জন্মসূত্রে জিনের মাধ্যমে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, তাই হল বংশগতি। বিশিষ্ট মনােবিদ স্টোন-এর মতে, বংশগতি হল কোনাে ব্যক্তির নিজস্ব সম্পদ যা সে তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে অর্জন করে।
মনােবিদ গ্যাল্টনের মতে, বংশগতির মাধ্যমে ব্যক্তি যেসকল বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, তার কিছু অংশ আসে সরাসরি তার পিতা-মাতার কাছ থেকে এবং অপর কিছু অংশ আসে পরােক্ষভাবে তার অন্যান্য পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে।
মােটকথা বংশগতি হল কোনাে ব্যক্তির সেইসকল সহজাত বৈশিষ্ট্য, যেগুলি নিয়ে সে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছে এবং যেগুলি পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে।
পরিবেশ :
সাধারণভাবে পরিবেশ বলতে বােঝায় ব্যক্তির চারপাশের সজীব ও নির্জীব উপাদানের সমষ্টি যা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ব্যক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। বিশিষ্ট মনােবিদ উডওয়ার্থের ভাষায়—পরিবেশ হল সেইসকল উদ্দীপকের যােগফল, যেগুলির প্রভাবে কোনাে ব্যক্তি আমৃত্যু সক্রিয় থাকে।
United Nations Environment Programme (1976)-এ পরিবেশের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেটি এখানে উল্লেখ করা হল। পরিবেশ হল পরস্পর ক্রিয়াশীল উপাদানগুলির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সেই প্রাকৃতিক ও জীবমণ্ডলীয় কৌশল যার মধ্যে মানুষসহ অন্যান্য জীব জীবনধারণ করে।
ডগলাস এবং হল্যান্ড-এর মতে, যেসকল বাহ্যিক শক্তি, প্রভাব এবং অবস্থা ব্যক্তির জীবন, প্রকৃতি, আচার-আচরণ, বৃদ্ধি, বিকাশ পরিণতি ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে, সেগুলির সমষ্টিই হল পরিবেশ।
শিক্ষার্থী হল বংশগত ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার গুণফল :
শিশু তথা শিক্ষার্থী হল শিক্ষার অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রকৃতপক্ষে শিশু বা ব্যক্তি যখন শিক্ষাগ্রহণ শুরু করে, অর্থাৎ কিছু শেখার চেষ্টা করে, তখন তাকে শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য করা হয়। শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী এমন কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করে, যা পরিবেশের সঙ্গে তাকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। মনােবিজ্ঞানীদের মতে, শিক্ষার্থী হল বিকাশমান, জীবন্ত জৈব শারীরসত্তা। শিক্ষার্থীর বংশগতিতার শিক্ষার ভিত্তি গঠন করে। কেননা তার বিকাশের বেশিরভাগ অংশই নির্ভর করে তার ভেতরে নিহিত উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্ভাবনার ওপর।
শিশুর বা শিক্ষার্থীর জীবন বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাবের মধ্যে কোনটি বেশি কার্যকারী হয়, তা নিয়ে মতবিরােধ রয়েছে। গ্যাল্টন, টারম্যান প্রমুখ বিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর জীবন বিকাশে বংশগতিই সব। শিশু জন্মসূত্রে পিতা-মাতার কাছ থেকে যা পেয়েছে তা কোনাে ধরনের শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায় না।
অন্যদিকে, ওয়াটসন, ক্যাটেল প্রমুখ পরিবেশবাদী বিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর জীবন বিকাশে বংশগতির কোনাে প্রভাব নেই বরং পরিবেশের প্রভাব রয়েছে। পরিবেশ শিশুকে যেভাবে গঠন করবে, সে সেভাবেই গড়ে উঠবে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে যে-কোনাে ব্যক্তিই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছােতে পারে।
বংশগতি ও পরিবেশের মধ্যে কোনটির গুরুত্ব বেশি, কোটির গুরুত্ব কম—এই নিয়ে দ্বন্দ্বের বা বিতর্কের মধ্যে না-গিয়ে কোনাে কোনাে বিজ্ঞানী বলেন — শিক্ষার্থী বা শিশু হল বংশগতিসূত্রে পাওয়া বৈশিষ্ট্যাবলি বা গুণাবলির পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে আন্তঃক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়ার যুগ্ম ফল। অনুকূল পরিবেশে বংশগতিসূত্রে পাওয়া বৈশিষ্ট্যাবলির স্বাভাবিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয় এবং উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে শিশুর বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। অন্যদিকে শুধু পরিবেশ দিয়ে কিছুই করা যায় না। বংশগতি ছাড়া পরিবেশ অর্থহীন। বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার ও পেজ (Maciver and Page)-এর মতে, ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি বিষয়ই বংশগতি ও পরিবেশের গুণফল। এদের কোনােটিকেই গুরুত্বহীন বলা যায় না। শিশুর জীবন বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশ উভয়ই সমগুরুত্বসম্পন্ন। উভয়ই অপরিহার্য উপাদান।
এখানে একটি প্রশ্ন বিভিন্ন সময়ে উপস্থিত হয়, তা হল— শিশু বা শিক্ষার্থীবংশগতি এবং পরিবেশের যােগফল কিনা, মনােবিজ্ঞানীদের মতে, শিশু বা শিক্ষার্থী হল বংশগতি ও পরিবেশের গুণফল। ব্যক্তি =বংশগতি x পরিবেশ। এটি কখনােই বংশগতি+পরিবেশ নয়।
উপরিলিখিত বিষয়গুলির ভিত্তিতে তাই বলা হয় — শিশু বা শিক্ষার্থী হল এক বিশেষ ধরনের মনােসামাজিক সত্তা, যাকে বংশগতি ও পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার বা আন্তঃস্ক্রিয়ার গুণফল হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।