প্রথম – দ্বিতীয় – তৃতীয় – চতুর্থ ও পঞ্চম স্তরের অর্থনৈতিক কার্যাবলির সংজ্ঞা এবং বৈশিষ্ট্য
অথবা, অর্থনৈতিক কার্যাবলীর সংজ্ঞা দাও।
অথবা, অর্থনৈতিক কার্যাবলীর শ্রেণীবিভাগ করো।
অথবা, অর্থনৈতিক কার্যাবলীর সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
অথবা, প্রথম/দ্বিতীয়/তৃতীয়/চতুর্থ স্তরের অর্থনৈতিক কার্যাবলির সংজ্ঞা দাও এবং বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করাে।
উত্তর:
অর্থনৈতিক কার্যাবলীর সংজ্ঞা (Definition of Economic Activities) :
দ্রব্য ও পরিষেবার উৎপাদন বন্টন বিনিময় ও ভোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কার্যাবলী কে অর্থনৈতিক কার্যাবলি বলা হয়৷ প্রকৃতপক্ষে যেসব কাজ করলে অন্য মানুষের চাহিদা মেটে, সম্পদের উপযোগিতা বৃদ্ধি ঘটে, মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটে, মানুষ স্বনির্ভর হয় এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় – মানুষের সেইসব ক্রিয়া-কলাপ কে অর্থনৈতিক কার্যাবলি বলে। এর মাধ্যমে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে, অর্থ উপার্জন করে, সমাজের চাহিদা মেটায়, সম্পদের উপযোগিতা বৃদ্ধি করে দেশ ও সমাজের আর্থসামাজিক বিকাশ ও উন্নতি ঘটে। এজন্য অর্থনৈতিক কাজকে অর্থনীতিবিদরা সামাজিক কাজ ও বলেন।
অর্থনৈতিক কার্যাবলীর শ্রেণীবিভাগ (Classification of Economic Activities) :
A) প্রাথমিক স্তরের অর্থনৈতিক কার্যাবলি (Primary Economic Activities) :
সংজ্ঞা : যেসব ক্ষেত্রে মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজন পূরণের তাগিদে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রত্যক্ষ ব্যবহার করে থাকে, তাকে প্রাথমিক ক্ষেত্রের অর্থনৈতিক কার্যাবলি বলে। অন্যভাবে বলা যায় যে, প্রাথমিক ক্ষেত্র হল এমন এক ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলি যা কাঁচামাল আহরণের সঙ্গে সম্পর্কিত।
উদাহরণ : শিকার, বনজ সম্পদ সংগ্রহ, মৎস্য চাষ, পশুপালন, পশুজ দ্রব্য আহরণ প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্য :
1) প্রাথমিক অর্থনৈতিক কার্যাবলী হলাে পৃথিবীর প্রাচীনতম বৃত্তি। এই প্রকার কাজের সঙ্গে যুক্ত লােকেদের লাল পােশাকের কর্মী (Red Collar Workers) বলা হয়।
2) প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান গুলির দ্বারা এই ক্ষেত্রের কার্যাবলী যথেষ্ট মাত্রায় প্রভাবিত হয়।
3) মানুষ মূলত নিজস্ব মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রয়ােজনে প্রাথমিক ক্ষেত্রের কার্যাবলী সম্পাদন করে।
4) প্রাথমিক ক্ষেত্রের কার্যাবলীর মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
5) প্রাথমিক ক্ষেত্রের কার্যাবলী প্রধানত গ্রামীণ পরিবেশেই বিকাশ লাভ করে।
6) প্রাথমিক ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত দ্রব্য অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ এর কাঁচামাল রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
7) পৃথিবীর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ মানুষ এই ধরনের কার্যাবলীর সঙ্গে যুক্ত।
B) দ্বিতীয় স্তরের অর্থনৈতিক কার্যাবলি (Secondary Economic Activities) :
সংজ্ঞা : যেসব কার্যাবলীর মাধ্যমে প্রাথমিক ক্রিয়াকলাপ থেকে প্রাপ্ত কাঁচামাল কারখানায় যন্ত্রাংশের দ্বারা রূপান্তরিত করে মূল্যবান দ্রব্য উৎপাদন করা হয়, সেই সকল কার্যাবলী কে দ্বিতীয় বা মাধ্যমিক ক্ষেত্রের কার্যাবলী বলা হয়। অর্থাৎ যেকোনাে ধরনের কোন দ্রব্যের প্রক্রিয়াকরনের সঙ্গে যুক্ত কার্যকে তৃতীয় শ্রেণীর কার্যাবলী বলা হয়।
উদাহরণ : খনিজ সম্পদ আহরণ ও শিল্পে উৎপাদন (অটোমােবাইল শিল্প, বৈদ্যুতিন শিল্প, রাসায়নিক শিল্প, নির্মাণ শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, বস্ত্র শিল্প, ভােগ্যপণ্য শিল্প) দ্বিতীয় শ্রেণীর কার্যাবলীর অন্তর্গত।
বৈশিষ্ট্য :
1) প্রকৃতি থেকে সরাসরি উপাদানগুলিকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তাদের বৈশিষ্ট্য বা গুণগত পরিবর্তন সাধনের সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যাবলী এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
- যেমন বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক মৎস্য শিকার ও তার প্রক্রিয়াকরণ।
2) এই ক্ষেত্রে কার্যাবলীর উৎকর্ষতা অনেকাংশে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়ােগের ওপর নির্ভরশীল।
3) এই প্রকার অর্থনৈতিক কার্যাবলির মাধ্যমে সম্পদের মান, মূল্য, উপযােগিতা ও কার্যকারিতার পরিবর্তন তথা উৎকর্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সম্পদ মানুষের নিকট ব্যবহারযােগ্য হয়ে ওঠে।
4) দ্বিতীয় শ্রেণীর অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ এর নিযুক্ত শ্রমিকদের ব্লু কলার ওয়ার্কার (Blue Collar Workers) বলা হয়।
C) তৃতীয় স্তরের অর্থনৈতিক কার্যাবলি (Tertiary Economic Activities) :
সংজ্ঞা : প্রাথমিক ও দ্বিতীয় ক্ষেত্রের সংযােগকারী পরিষেবা মূলক কাজ, যা প্রাথমিক দ্বিতীয় ক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে তাকে তৃতীয় বা সেবা ক্ষেত্রের অর্থনৈতিক কার্যাবলি বলে।
উদাহরণ : পরিবহন ও যােগাযােগ, খুচরাে ও পাইকারি ব্যবসা, প্রশাসনিক কাজকর্ম, ব্যাংকবীমা ব্যবস্থা, বিনােদনমূলক কাজকর্ম, চিকিৎসা ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা প্রভৃতি হলাে তৃতীয় ক্ষেত্রের অর্থনৈতিক কাজ।
বৈশিষ্ট্য :
1) এই স্তরের কাজ প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের কাজের মধ্যে সংযােগ স্থাপন করা এবং প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের কাজের উৎপাদন ও গুণমান বৃদ্ধি করা।
2) এই কাজের মাধ্যমে সাধারণ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিষেবা প্রদান করা হয়।
3) এক্ষেত্রে স্পর্শযােগ্য বস্তু অপেক্ষা অস্পর্শযােগ্য উপাদানের ওপর অধিক গুরুত্ব আরােপ করা হয়।
4) এই স্তরের কাজ অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করে।
5) এই স্তরের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের গােলাপী পােশাক কর্মী (Pink Collar Workers)বলে।
6) বর্তমান ভারতের মােট শ্রমজীবী মানুষের শতকরা প্রায় 23 ভাগ পরিষেবা মূলক ক্রিয়াকলাপ এর সাথে যুক্ত৷ উন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলির বেশিরভাগ মানুষই এই ক্ষেত্রে সাথে যুক্ত। যেমন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 80% মানুষ তৃতীয় স্তরের ক্রিয়াকলাপ এর সাথে যুক্ত।
D) চতুর্থ স্তরের অর্থনৈতিক ক্রিয়া-কলাপ বা কোয়াটারনারি সেক্টর (Quaternary Activities) :
সংজ্ঞা : যে সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যাবলী জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে সম্পাদিত হয় তাকে চতুর্থ ক্ষেত্রের কার্যাবলী বলে। অতি উন্নত মেধা ও দক্ষতার সাহায্যে অর্থনৈতিক উদ্যোক্তার মাধ্যমে বিশেষ পেশাদারি ও প্রশাসনিক পরিষেবা মূলক যে কার্যাবলী সাম্প্রতিক কালে বিকাশ লাভ করেছে তাদের নব্য আধুনিক কার্যাবলী বলে। অন্যভাবে বললে মানুষের জ্ঞান ও মেধা এবং প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে তৃতীয় বা সেবা ক্ষেত্রে কার্যক্রম আরো উন্নত হয় তখন তাকে নব্য ক্ষেত্রের অর্থনৈতিক কার্যাবলি বলে।
উদাহরণ : তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প, তথ্য বিশ্লেষণ, তথ্য আদান-প্রদান, মিডিয়া, রিয়েল এস্টেট, কম্পিউটার ও টেলিযােগাযােগ প্রভৃতি।
বৈশিষ্ট্য :
1) চতুর্থ ক্ষেত্রের কার্যাবলী মূলত সেবামূলক ক্ষেত্রেরই একটা অংশ।
2) উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী ব্যক্তিরা সাধারণত এই ধরনের কার্যাবলীর সাথে যুক্ত থাকেন।
3) বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে এই ধরনের ক্ষেত্রের উদ্ভব হয় এবং মূলত উন্নত দেশগুলিতে এর সর্বাধিক বিকাশ ঘটে।
4) এইসব ক্ষেত্রে সব কাজ অফিস বিল্ডিং বা ছাদের তলায় অফিসে বসে হয়।
5) পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কর্মরত এইসব শ্রমিকদের সাদা কলার শ্রমিক বা হােয়াইট কলার ওয়ার্কার্স (White Collar Workers) বলে।
E) পঞ্চম স্তরের অর্থনৈতিক ক্রিয়া-কলাপ / কুইনারি কার্যাবলী (Quinary Activities) :
সংজ্ঞা : কোয়াটারনারি কাজের উর্ধ্বে যে আরও উন্নত ও অত্যাধুনিক কাজের বিস্তার ঘটে তাকে কুইনারি অর্থনৈতিক কার্যাবলি বলে। প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিক, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ক্ষেত্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও নীতি নির্ধারণকারী অর্থনৈতিক কাজ এই ক্ষেত্রের অন্তর্গত।
উদাহরণ : বিজ্ঞানী, আইন বিশেষজ্ঞ, দূর সংবেদন ও GIS সংক্রান্ত কার্যাবলী তে নিযুক্ত উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, শীর্ষস্থানীয় সরকারি আধিকারিক প্রমুখ।
বৈশিষ্ট্য :
1) পঞ্চম ক্ষেত্রের কার্যাবলী অর্থনৈতিক অর্থনীতির সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাজ।
2) উন্নত মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে এই ধরনের কার্যাবলী সম্পাদিত হয়। এই ক্ষেত্রে কর্মী নিয়ােগের পরিমাণ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলি তুলনায় কম।
3) পঞ্চম ক্ষেত্রের কার্যাবলী কে নিযুক্ত ব্যক্তিরা অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত উচ্চমানের বেতন লাভ করে থাকেন।
4) এই ক্ষেত্রে নিযুক্ত কর্মীদের সোনালী কলার কর্মী (Golden Collar Workers)বলা হয়।
5) সমাজের অলাভজনক কার্যাবলীকে (যেমন গৃহকর্মে যুক্ত মানুষ) এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
6) এই পেশায় যুক্ত লােকেরা think-tank বা বুদ্ধির ভান্ডার হিসেবে কাজ করেন।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।