প্রশ্নঃ ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা করো ?
উত্তরঃ-
ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা :
ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার অনুকরণে ভারতে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে এবং ব্রিটেনের মতো এখানে একজন নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান রূপে রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ডক্টর আম্বেদকর গণপরিষদে বলেছিলেন, ” আমাদের রাষ্ট্রপতি ব্রিটেনের রাজার মতো সমান পদ মর্যাদার অধিকার”। তাই তিনি রাষ্ট্রের প্রধান সরকারের প্রধান নন,তিনি জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন কিন্তু জাতিকে শাসন করেন না। তার সত্বেও সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় তাকে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যাতে তাকে একজন নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান বলা যাবে না।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলীঃ
সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় রাষ্ট্রপতিকে যেসব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা নিম্নলিখিতভাবে আলোচনা করা যায়-
ক) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ সংবিধানের ৫৩ (১) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে কেন্দ্রে যাবতীয় শাসন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে। তার নামে সব কাজ চলবে। এই অধিকার বলে তিনি নিম্নলিখিত শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা ভোগ করেন।
১) নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতাঃ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নিয়োগ করেন এছাড়া তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল,অডিটর জেনারেল, নির্বাচন কমিশনার “রাজ্যপাল ইত্যাদি ব্যক্তিদের নিয়োগ করেন আবার রাজ্যপাল,মন্ত্রী প্রভৃতি ব্যক্তিদের অপসারিত করতে পারেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যদেরও অপসারিত করার ক্ষমতা তার আছে। তবে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগে।
২) সামরিক ক্ষমতাঃ রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক । এই ক্ষমতা বলে তিনি স্থল, বিমান এবং নৌবাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ করেন। যুদ্ধ ও শান্তি ঘোষণার দায়িত্ব তার। তবে এগুলিকে কার্যকর করতে গেলে পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগে।
খ) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ ব্রিটেনের রানীর মতো রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অংশ তার ফলে তিনি নিম্নলিখিত আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা ভোগ করেন-
১) অধিবেশন আহ্বান: রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করেন। প্রথম অধিবেশনে উদ্বোধনী ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতি গুলিকে লোকসভা ও রাজ্যসভায় জানান। যে কোন কক্ষের অধিবেশন স্থগিত রাখতে পারেন। প্রয়োজনে লোকসভা ভেঙে দিতে পারেন। কোন বিষয়ের ওপর কক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে তার মীমাংসার জন্য উভয় কক্ষে যৌথ অধিবেশন ডাকতে পারেন।
২) বিলের অনুমোদনঃ রাষ্ট্রপতি সম্মতি ছাড়া কোন বিল আইনে পরিণত হয় না। তিনি কোন বিল স্বাক্ষর না করে পুনরায় বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন। তবে অর্থ বিলে সম্মতি দিতে তিনি বাধ্য। এছাড়া কোন রাজ্যপাল রাজ্যের আইনসভার অনুমোদিত কোন বিল সম্মতির জন্য তার কাছে পাঠাতে পারেন। তার কাছে পাঠানো বিলের রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিতে পারেন, নাও পারেন আবার পুনরবিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন।
৩) জরুরী আইন জারিঃ যখন সংসদের অধিবেশন থাকে না তখন রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন হলে জরুরি আইন বা অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারে। এগুলি আইনের মত কার্যকর হয়। তবে পরে সংসদের অনুমোদন নিতে হয়।
গ) বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করেন ৷ তাছাড়া আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত যেকোনো ব্যক্তিকে ক্ষমা করতে পারেন মৃত্যুদণ্ড রদ করতে পারেন।
ঘ) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ছাড়া কোন ব্যয় মঞ্জুরীর প্রস্তাব সংসদে পেশ করা যায় না। আকস্মিক তহবিলের দায়িত্ব তার হাতে থাকে। কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে অর্থ বন্টনের জন্য তিনি অর্থ কমিশন গঠন করেন।
ঙ) জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতাঃ রাষ্ট্রপতি তিন ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন-
১) জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণাঃ ৩৫২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যুদ্ধ বা আক্রমণের ফলে ভারতের বা তার কোন অংশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে বা হতে পারে তখন তিনি জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। তবে এক মাসের মধ্যে তাকে সংসদের অনুমোদন নিতে হয়। এই ঘোষণার ফলে তিনি স্বাধীনতার অধিকার স্থগিত রাখতে পারেন। রাজ্যকে শাসনের ব্যাপারে নির্দেশ দিতে পারেন।
২) রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক অচল অবস্থা ঘোষণাঃ ৩৫৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি যদি রাজ্যপাল বা অন্য কোন সূত্র থেকে জানতে পারেন যে কোন রাজ্য সংবিধান অনুযায়ী চলছে না তখন তিনি সেই রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচল অবস্থা ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারেন। এই ঘোষণার মাধ্যমে সেই রাজ্যের শাসনভার নিজের হাতে নিতে পারেন। পার্লামেন্টের হাতে রাজ্যের আইনসভার ক্ষমতা তুলে দিতে পারেন।
৩) আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণাঃ ৩৬০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে ভারতে বা তার কোন অংশে যদি আর্থিক সুনাম নষ্ট হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি রাজ্যকে আর্থিক ব্যাপারে নির্দেশ দিতে পারেন। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা কমাতে পারেন।
পদমর্যাদাঃ রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা নিয়ে বিতর্ক আছে l অধ্যাপক পায়লি বলেছেন রাষ্ট্রপতি বিশাল ক্ষমতার অধিকারী। অন্যদিকে অধ্যাপক দুর্গাদাস বসু, আম্বেদকর প্রভৃতি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন রাষ্ট্রপতির প্রকৃত কোন ক্ষমতা নেই।
প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী:
প্রথমতঃ সংবিধানের ৫৩(১) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে। তিনি নিজে বা কর্মচারীদের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন । এতে প্রমাণিত হয় সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী।
দ্বিতীয়তঃ রাষ্ট্রপতি বিশেষ অবস্থায় নিজের খুশিমতো প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ করতে পারেন। যেমন সংখ্যালঘু দলের চরণ সিং কে নিয়োগ করা হয়েছিল।
তৃতীয়তঃ রাষ্ট্রপতি নিজের খুশি মত জরুরি আইন বা অর্ডিন্যান্স জারি এমনকি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে পারেন। এইসব কাজ সংবিধান বিরোধী হবে না।
চতুর্থতঃ রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে নেই। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে লোকসভার আস্থা ভোট নিতে বলতে পারেন। যেমন ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী কে আস্থা ভোট দিতে বাধ্য করেছিলেন।
প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী নয়:
প্রথমতঃ ৪২ তম সংশোধনী পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।
দ্বিতীয়তঃ ৪৪ তম সংশোধনী বলা হয়েছে মন্ত্রিসভার প্রস্তাব ছাড়া রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন না।
তৃতীয়তঃ মন্ত্রিসভা লোক সবার কাছে দায়ী থাকে রাষ্ট্রপতির কাছে নয়। রাষ্ট্রপতি প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হলে মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির কাছে দায়ী থাকতেন।
উপসংহার: ভারতের রাষ্ট্রপতির উল্লিখিত ক্ষমতা বিশ্লেষণের পর রাষ্ট্রপতিকে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে হতে পারে। তত্ত্বগতভাবে তিনি তাই, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অন্য। রাষ্ট্রপতি যে ক্ষমতাই প্রয়োগ করুক-না-কেন তাকে মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। তিনি হলেন
নামসর্বস্ব শাসক, প্রকৃত শাসক নন। তিনি শুধুমাত্র নামসর্বস্ব শাসক নন, ভারতের রাষ্ট্রপতি জাতির প্রতীক, সংবিধানের রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান কিন্তু শাসন বিভাগের প্রধান বলে বিবেচিত হন না। তা সত্ত্বেও ভারতের রাষ্ট্রপতিকে দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।
Read Also
ভারতের সংবিধান প্রস্তাবনার গুরুত্ব বা তাৎপর্য আলোচনা করো
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন | Non-Aligned Movement in Bengali
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।