জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন | Non-Aligned Movement in Bengali

উত্তরঃ-

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন
Non-Aligned Movement

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটা বড়ো রকমের পরিবর্তন ঘটে যায়। কোথাও বিনা প্রতিরোধে, কোথাও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বহু পরাধীন দেশ সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পায়। এই সদ্য স্বাধীন দেশগুলির প্রত্যেকের তখন একটাই চিন্তা-ঠান্ডা লডাই-এর পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে নিজের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বজায় রাখা যায় এবং কীভাবে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এরা প্রত্যেকেই ভেবে নিয়েছিল যে, মার্কিন জোট এবং সোভিয়েত জোট কোনো পক্ষেই যোগ না দিয়ে উভয় পক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে চলাটাই জাতীয় স্বার্থের অনুকূল হবে। এই ধরনের বিচারবিবেচনা থেকেই তারা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং কালক্রমে এটি একটি আন্দোলনের রূপ নেয়।

গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনঃ

ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ৫ মাস আগে ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে, দিল্লিতে এশীয় বিষয়ক যে সম্মেলনটি (Asian Relations Conference) অনুষ্ঠিত হয় সেখানেই জোটনিরপেক্ষ নীতির অঙ্কুরোদ্রম হয়।

পঞ্চশীলঃ

১৯৫৪ সালে এপ্রিল মাসে ভারত-চিন সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য যে পঞ্চশীল নীতি গ্রহণ করা হয়, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে তা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পঞ্চশীলের আদর্শগুলি হল : (১) ভূখণ্ডগত অথণ্ডতা এবং সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন, (২) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, (৩) অনাক্রমণ, (৪) অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা এবং (৫) সাম্য ও পারস্পরিক সাহায্য।

বান্দং সম্মেলন:

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অপর একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হল ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং-এ অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় দেশগুলির এক ঐতিহাসি সম্মেলন (Bandung Conference) | এই সম্মেলনে যে ২৯টি দেশ যোগ দিয়েছিল তার মধ্যে সবাই যে জোটনিরপেক্ষ ছিল তা নয়। পাকিস্তান, তুরস্ক, ইরান, ইরাক, ফিলিপাইনস্ ও থাইল্যান্ডের মতো সামরিক জোটব রাষ্ট্রগুলিও এই সম্মেলনে যোগ দেয়। উপস্থিত দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিরোধের জন্য এই সম্মেলন পুরোপুরি সাফল্য লাভ করতে না পারলেও, এই সম্মেলনের ফলে জোটনিরপেক্ষ নীতির ভিত্তি সুদৃঢ় হয় । 

বেলগ্রেড শীর্ষ সম্মেলন :

১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকে জোটনিরপেক্ষ নীতির সমর্থক দেশগুলিকে নিয়ে একটা শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, ইজিপ্টের নাসের, ভারতের জওহরলাল নেহেরু, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ প্রমুখ নেতার চেষ্টায় ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে প্রথম জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ২৫টি জোট-নিরপেক্ষ দেশের প্রতিনিধি যোগদান করেন।

এই সম্মেলনের মাধ্যমে জোটনিরপেক্ষতার ধারণাটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। তাই এই বেলগ্রেড সম্মেলনকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠার সূচক বলে মনে করা হয়। 

বেলগ্রেড সম্মেলনের পর প্রায় তিন বছর অন্তর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় কায়রোতে ১৯৬৪ সালে। কায়রো সম্মেলনের পরবর্তী

কয়েকটি বছরে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তোলে। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে দেরি হলেও তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে লুসাকাতে। অতঃপর নিয়মিতভাবে প্রতি তিন বছর অন্তর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। 

আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাঃ

বর্তমান বিশ্বে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কোনো প্রাসঙ্গিকতা বা গুরুত্ব আছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর থেকে। যাঁরা বলেন বর্তমানে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই তাঁরা নিম্নলিখিত যুক্তির অবতারণা করে থাকেন:

প্রথমত: ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জোটনিরপেক্ষতার উদ্ভব ঘটে। দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করে বিশ্বকে প্রায় ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের সার্বভৌমিকতাকে রক্ষা করতে জোটনিরপেক্ষতার প্রয়োজন ছিল। এখন ঠান্ডা যুদ্ধের দিন শেষ। দ্বি-মেরুবাদের অবসান হয়েছে। তাই নির্জোট আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা নেই।

দ্বিতীয়তঃ পূর্বে নির্জোট আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল দুই শিবির থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখা। কিন্তু বর্তমানে শক্তিধর রাষ্ট্র বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব নয়। বরং তার সাহায্য নিতেই হবে। এই অবস্থায় জোটনিরপেক্ষতার নীতি আর প্রাসঙ্গিক নয়।

তৃতীয়ত: নির্জোট আন্দোলন সমদূরত্ব বজায় রাখলেও তাদের পিছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচ্ছন্ন মদত ছিল। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। তাই জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠী তাদের পরম বন্ধুকে হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির কাছে তাদের আন্দোলন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।

এই আন্দোলন প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি:

এ কথা সত্য, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে ওঠার সময় যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ছিল তার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। তাতে মনে হতে পারে জোটনিরপেক্ষতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবে বিশ্বের রাজনীতিতে অশনিসংকেত দেখা দিচ্ছে। তাতে অনেকে মনে করেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। 

প্রথমত: বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাপট ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এর মোকাবিলা করার জন্যে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত: তৃতীয় বিশ্বের সদস্য অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও তারা নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে পারছে না। একমাত্র নির্জোট আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তাদের আসন পাকাপাকি করতে পারে।

তৃতীয়ত: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঠান্ডা লড়াই-এর অবসান হলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন করে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক সংঘাত শুরু হয়েছে। এই অবস্থায় নির্জোট সম্মেলনকে বাঁচিয়ে রেখে অর্থনৈতিক লড়াই চালাতে হবে।

চতুর্থত: শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যাচ্ছে, অথচ অন্যদের বাধা দিচ্ছে। পরমাণু অস্ত্রের সম্প্রসারণ রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর দেবার জন্য ভয় দেখাচ্ছে। এর জন্যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে সংঘবদ্ধ ভাবে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি শামিল হয়েছিল। আজও তাদের সংঘবদ্ধ থাকতেই হবে। এটি তাদের

মুল্যায়নঃ

অস্তিত্বের লড়াই। পশ্চিমি শক্তি তাদের ঐক্যকে ভাঙতে সচেষ্ট। জোট- নিরপেক্ষ দেশগুলিকে এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। কারণ জোটবদ্ধতার বিকল্প হল সম্মিলিত বিনষ্টি।

Read Also

রুশোর স্বাধীনতার ধারণাটি আলোচনা করো | রুশোর চিন্তায় জনগণের সার্বভৌমিকতা ধারণাটি বর্ণনা করো

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment