রুশোর স্বাধীনতার ধারণাটি আলোচনা করো | রুশোর চিন্তায় জনগণের সার্বভৌমিকতা ধারণাটি বর্ণনা করো

উত্তরঃ-

“রুশো মনে করেছেন মানুষ প্রকৃতিগতভাবে ভালো এই সমাজ ও সভ্যতা তাকে মন্দ করে। রুশোর মতে – ” মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে কিন্তু সর্বোত্তই সে শৃঙ্খলিত”। রুশোর মতে প্রাকৃতিক রাজ্য ছিল “মর্ত্যের স্বর্গ” সেখানে মানুষ অল্পের সন্তুষ্ট থাকতো, সেখানে মানুষ শুধু সম্পদ ও সুনাম অর্জনের জন্য ছুটে না। এত কিছু থাকার সত্বেও মানুষ প্রকৃতির রাজ্য ত্যাগ করে রাষ্ট্রীয় সমাজ গঠন করে। কারণ প্রকৃতির রাজ্যের মধ্যেও কিছু অসুবিধা দেখা দেয়। দেখা দেয় অসাম্য বৈষম্য নীতিহীনতা। ফলে মানুষ চুক্তি করে সমস্ত ক্ষমতা সাধারণ ইচ্ছা হাতে অর্পণ করলো।

রুশো তাঁর সাধারণ ইচ্ছা ধারণার মাধ্যমে এই স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দ্বন্দ্বের নিরসন করতে চান। রুশোর মতে, মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে যে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা ভোগ করত তা সবই সমর্পণ করল সকলের যৌথ ব্যক্তিত্বের কাছে, যাকে তিনি বলেছেন সাধারণ ইচ্ছা। কিন্তু সবকিছু সমর্পণ করেও সে কিছুই হারাল না, কারণ সে কোনো ব্যক্তির কাছে বা প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজের সবকিছু সমর্পণ করেনি। সমর্পণ করেছিল তাদের সকলের সম্মিলিত শক্তির কাছে। সুতরাং ব্যক্তি হিসাবে সে যা হারাল, সমগ্রের অংশীদার হিসাবে সবটাই সে ফিরে পেল। ফলে সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছার অধীনতা স্বীকার করেও প্রত্যেক ব্যক্তি স্বাধীনই থেকে গেলা। 

সমাজনিরপেক্ষ স্বাধীনতা বা নিয়ন্ত্রণবিহীনতা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বুর্জোয়া স্বাধীনতার বৈশিষ্ট্য। এধরনের স্বাধীনতাকে রুশো কখনই স্বাধীনতা বলে স্বীকার করতে পারেননি। তিনি যে স্বাধীনতার কথা বলেছেন, তার উপলব্ধি ঘটে কেবলমাত্র সমাজের মধ্যে। তাই রুশোর বক্তব্য ছিল, সমাজকে মুক্ত করেই সমাজের মধ্যে ব্যক্তির মুক্তি সম্ভব এবং তা করায় উপায় হল রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ। প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই উপলব্ধি করা যায় যখন কর্তৃত্বের সঙ্গে স্বাধীনতার কোনো বিরোধ থাকে না। ব্যক্তিস্বার্থ যদি সমষ্টিস্বার্থের বিরোধী হয়,তাহলে সেক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিয়েছেন জনগণের সম্মিলিত শক্তির হাতে। অতএব, রুশোর আদর্শ রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলেও সাধারণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেই সম্পত্তি পরিচালনার ক্ষমতা শাসকের নেই।

রুশোর মতে, প্রকৃতির রাজ্যের মানুষেরা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে তাদের সকল ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্পণ করেনি, অর্পণ করেছিল এক যৌথ ব্যক্তিত্বের কাছে, রুশোর ভাষায় সাধারণ ইচ্ছার কাছে। এই সাধারণ ইচ্ছাই হল সার্বভৌম্য। সার্বভৌমের প্রকৃতি প্রসঙ্গে রুশোর বক্তব্য হল, সার্বভৌম ক্ষমতা বৈধ এবং ন্যায়সঙ্গত। সার্বভৌম ক্ষমতা বৈধ এই কারণে যে, মানুষ স্বেচ্ছায় তাদের সকল ক্ষমতা সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছার নিকট হস্তান্তরিত করেছিল। এইভাবে সকলের স্বেচ্ছাদত্ত সম্মতির ভিত্তিতে সৃষ্ট বলেই সার্বভৌম ক্ষমতা বৈধতা অর্জন করে।

বৈশিষ্ট্যঃ

রুশো তাঁর ‘The Social Contract’ গ্রন্থে সার্বভৌমিকতার যেসব বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন, তা নিম্নলিখিতভাবে বর্ণিত হল :

প্রথমতঃ রুশোর মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তরযোগ্য নয়। কারণ, রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে পারে শুধু সাধারণ ইচ্ছা, অন্য কেউ নয়। সার্বভৌম ক্ষমতা হল একটি সমষ্টিগত ব্যক্তিত্ব।

দ্বিতীয়তঃ সার্বভৌম ক্ষমতা শুধু অ-হস্তান্তরযোগ্যই নয়, অবিভাজ্যও (Indivisible)। সার্বভৌমকে বিভক্ত করার অর্থই হবে একে ধ্বংস করা।

তৃতীয়তঃ রুশোর মতে, সার্বভৌমিকতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর সামান্যধর্মিতা (Generality)। সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছা যেহেতু সকলের প্রকৃত বা কল্যাণকর ইচ্ছার সমষ্টি, সেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতা হল সাধারণ বা সর্বজনীন।

চতুর্থতঃ রুশোর মতে, সার্বভৌমিকতার অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল অভ্রান্ততা (infallibility)। তিনি বলেন, সাধারণ ইচ্ছা সর্বদা সঠিক কাজ করে এবং জনগণের স্বার্থেই কাজ করে।

পঞ্চমতঃ রুশোর মতে সার্বভৌম শক্তি চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। সার্বভৌম শক্তি যেহেতু অভ্রান্ত এবং সমষ্টি মঙ্গলের স্বার্থে কাজ করে, সেহেতু প্রত্যেকেই তাকে মান্য করতে বাধ্য।

মুল্যায়ন: রুশোর সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছা সম্পর্কিত তত্ত্ব যুগান্তকারী বলে বন্দিত হলেও সমালোচকেরা এই তত্ত্বের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটির উল্লেখ করেছেন। অনেকে বলেন তাঁর সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত৷

Read Also

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন | Non-Aligned Movement in Bengali

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment