বাংলা উপন্যাসের ধারায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর অবদান লেখ

বাংলা উপন্যাসের ধারায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর অবদান লেখ

উত্তর:

বাংলা উপন্যাসের ধারায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর অবদান

রবীন্দ্র-শরৎ পরবর্তীযুগে বাংলা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ভার যাদের উপর ন্যস্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বন্দ্যোপাধ্যায় এয়ী অর্থাৎ তিন বন্দ্যোপাধ্যায়। এদের মধ্যে বয়ােঃজ্যোষ্ঠ ছিলেন বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়(১৮৯৪-১৯৫০), এরপর তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়( ১৮৯৮-১৯৭১) এবং বয়ােঃকনিষ্ঠ ছিলেন মনিক বন্দ্যোপাধ্যায়(১৯০৮-১৯৫৬)। এরা বাংলা কথাসাহিত্যকে বঙ্কিমের ইতিহাস প্রবণতা থেকে, রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যতত্ত্ব এবং শরৎচন্দ্রের আবেগ সর্বস্বতা থেকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে বিভূতিভূষণ তাঁর গল্প-উপন্যাসে প্রকৃতি ও মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে এসে এই দুইয়ের সম্পর্ক দেখান এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্রয়েডীয় মনােবিকলন তত্ত্ব ও মার্কসীয় সাম্যবাদকে তাঁর কথাসাহিত্যে প্রয়ােগ করেন। আর আমাদের আলােচ্য তারাশংকর নিজে ছিলেন এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশের সন্তান। তার সময় বাংলাদেশ থেকে সামন্ততন্ত্র অর্থাৎ জমিদারতন্ত্র লােপ পাচ্ছিল এবং ধনতন্ত্র প্রভাব বিস্তার করছিল। দুইকালের দ্বন্দ্বকেই রূপদান করেছেন। পাশাপাশি বীরভূমের ময়ুরাক্ষী তীরবর্তী লাভপুরের মানুষ তারাশংকর যে অঞ্চলের মানুষ হয়েছিলেন তার সেই অঞ্চলকেই নিজের সাহিত্যে স্থান দিয়ে বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিকতার আমদানি ঘটান।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

আমরা পূর্বেই বলেছি যে, তারাশংকর বীরভূমের লাভপুরে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করে বর্ধিত হয়েছিলেন। এই অঞ্চলটি দীর্ঘকাল ধরে বাংলার ভৌগােলিক পরিবেশে রাঢ় অঞ্চল নামে পরিচিত। এখানে উচ্চবর্ণের মানুষের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর পরিমানে সাওতাল, বাগদি, দুলে, কাহার, কোল, মুন্ডা, সদগােপ প্রভৃতি নিম্নবর্ণের মানুষজন বসবাস করে আসছে। জমিদারের সন্তান তারাশংকর তাঁর রচনায় সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের বিরােধ দেখাতে গিয়ে এই নিম্নবর্ণের ও নিম্নবৃত্তির মানুষজনকেই বারবার চিত্রিত করেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালীঘূর্ণি’ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং শেষ উপন্যাস ‘নবদিগন্ত ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এর মাঝে তিনি যে সমস্ত উপন্যাস লিখেছেন তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল‘পাষাণপুরী’(১৯৩৩), ‘নীলকণ্ঠ’(১৯৩৩), “রাইকমল’(১৯৩৪), প্রেম ও প্রয়ােজন’(১৯৩৫), ‘আগুন’(১৯৩৭), ধাত্রীদেবতা’(১৯৩৯), কালিন্দী’(১৯৪০), গণদেবতা’(১৯৪২), মন্বন্তর’(১৯৪৪), ‘পঞ্চগ্রাম’(১৯৪৪), ‘কবি’(১৯৪৪), ‘সন্দীপণ পাঠশালা’(১৯৪৫), ‘ঝড় ও ঝড়াপাতা’(১৯৪৬), ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’(১৯৪৭), ‘পদচিহ্ন’(১৯৫০), “উত্তরায়ণ’(১৯৫০), তামস তমস্যা’(১৯৫২), “নাগিনী কন্যার কাহিনী’(১৯৫২), ‘আরােগ্য নিকেতন’(১৯৫৩), ‘চাপা ডাঙ্গার বৌ’(১৯৫৪), সপ্তপ্রদীপ’(১৯৫৭), ‘রাধা’(১৯৫৪), ‘না’(১৯৬০), ‘নাগরিক’(১৯৬০), “কালবৈশাখী’(১৯৬৩), মঞ্জুরী অপেরা’(১৯৬৪), ‘ভূবনপুরের হাট’(১৯৬৪), ‘অরণ্যবহ্নি’(১৯৬৬), ‘মহানগর’(১৯৬৬), ‘ফরিয়াদ’(১৯৭১) প্রভৃতি।

তারাশংকরের প্রথম পর্বের উপন্যাসগুলিতে বন্ধনমুক্তির ব্যকুলতা এবং বৈষ্ণবীয় চেতনা স্থান পেয়েছে। তারাশংকর জমিদারের সন্তান এবং ঔপন্যাসিক হলেও আদ্যোন্ত ছিলেন একজন সক্রিয় কংগ্রেস কর্মী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ইংরেজ বিরােধি কার্যকলাপের জন্য তিনি জেল পর্যন্ত খাটেন। আবার তারাশংকর যে অঞ্চলের মানুষ সে অঞ্চলে দীর্ঘদিন বৈষ্ণবধর্ম ব্যপক বিস্তার লাভ করেছিল। চৈতালীঘূর্ণি’ ‘পাষাণপুরি’ ‘রায়কমল’, ‘আগুন’ প্রভৃতি প্রথম দিককার উপন্যাসগুলিতে তারাশংকর এই রাজনীতি ও বৈষ্ণবধর্মকে স্থান দিয়েছেন।

এরপর তারাশংকরের ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘কালিন্দী’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘কবি’ প্রভৃতি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এগুলি ঔপন্যাসিক তারাশংকরের জীবনের মাইলফলকও বটে। এর মধ্যে ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসের নায়ক শিবনাথের মধ্য দিয়ে তারাশংকর নিজেকেই প্রকাশ করেছেন জন্য অনেকেই এই উপন্যাসটিকে তারাশংকরের আত্মজীবনিমূলক উপন্যাস বলেন। তারাশংকরের ‘গণদেবতা’ ও তার পরিপুরক উপন্যাস ‘পঞ্চগ্রাম’-এ রাঢ় অঞ্চলের মানুষজনের নিরিখে সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের বিরােধকে দেখানাে হয়েছে। এই দু’টি উপন্যাসে পুরাতন দিনের প্রতিনিধি দেবুঘােষ ও তার অনুগামীরা আর ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি ছিরু পাল অর্থাৎ শ্রীহরি।

রাঢ় অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কবিগান জনপ্রিয়। এই কবিগান এবং তার দর্শককে তারাশংকর তার ‘কবি’ উপন্যাসে নিতাই কবিয়ালের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন। এই উপন্যাসে নিতাই-এর গান ‘কালাে যদি মন্দ তবে কেশ পকিলে কান্দো কেনে’, ‘হায় জীবন এত ছােট কেনে’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। আর ‘কালিন্দী’ উপন্যাসে কালিন্দী নদীর তীরে গড়ে ওঠা একটি চরকে কেন্দ্র করে জমিদারতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষকে তিনি দেখিয়েছেন। তারাশংকরের এই পর্বে দুই কালের দ্বন্দ্ব যেমন বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। তেমনি রাঢ় অঞ্চলও আংশিকভাবে এসেছে।

রাঢ় অঞ্চল, তার প্রকৃতি, সে অঞ্চলের মানুষজন এবং তাদের জীবন জীবিকাকে তারাশংকর বাস্তবসম্মত ভাবে তুলে ধরেছেন তার পরবর্তী উপন্যাস ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী, ‘আরােগ্য নিকেতন’, ‘সপ্তপ্রদীপ প্রভৃতিতে। এর মধ্যে রাঢ় অঞ্চলের কোপাই নদীর তীরে গড়ে ওঠা হাঁসুলি বাক এবং সেখানে বাস করা কাহার সম্প্রদায়ের মানুষজনদের নিয়ে গড়ে ওঠা ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসখানি এখন পর্যন্ত লেখা বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাসগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এখানে বনােয়ারীলাল এবং করালীচরণের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে দুই কালের দ্বন্দ্বকে দেখানাে হয়েছে। তার ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’-তে বেদে সম্প্রদায়ের বাস্তব জীবন উঠে এসেছে। আরােগ্য নিকেতন’ উপন্যাসটিতে প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বন্দ্বকে দেখানাে হয়েছে। এই উপন্যাসের জীবনমশাই চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযােগ্য চরিত্র।

তারাশংকর শেষ পর্যায়ে ‘মহাশ্বেতা’, ‘যােগভ্রষ্ট’, ‘মঞ্জরি অপেরা’, ‘ভূবনপুরের হাট’, ‘গন্নাবেগম, ‘অভিনেত্রী ফরিয়াদ’ প্রভৃতি উপন্যাস রচনা করেন। এ সময় তারাশংকর অনেকটাই আধ্যাত্মবাদের দিকে ঢুকে গেছেন। ফলে তিনি উপন্যাসের চলতি রীতিকেও অনেক সময় ভেঙ্গে দিয়েছেন। এই উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘গন্নাবেগম’ তারাশংকরের ঐতিহাসিক উপন্যাস।

এবাবে তারাশংকর প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ষাটটির মত উপন্যাস রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলি বরাবরই ছিল মানবতার রসে পূর্ণ। মানুষকে তিনি যেভাবে দেখেছিলেন উপন্যাসে তাদের সেভাবেই প্রতিফলিত করেছেন। তার চরিত্র পরিকল্পনায় উচ্চবর্ণের পাশাপাশি নিম্নবর্ণের মানুষেরা সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। আর একারনেই তিনি হয়ত জনপ্রিয় হয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন —

“উত্তর শরৎচন্দ্রের যুগে তিনি যে সর্বশ্রেষ্ঠ তাতে আজ আর দ্বিধা নেই।” ড, বন্দ্যোপাধ্যায় তারাশংকের সম্পর্কে আর ও বলেছেন —-
“তার উপন্যাস ও ছােটগল্পে যে দুর্লভ বলিষ্ঠতা ও তীব্র আন্তর দৃষ্টির পরিচয় রয়েছে এবং বিশাল মানববােধের চিত্র, ঐতিহাসিক জীবনচিত্র যেভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাতে শরৎচন্দ্রকে হারিয়ে আমাদের আর ক্ষোভ নেই।”
তাঁর যােগ্য উত্তরাধিকার বহন করে তারাশংকর যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তা আজও বহমান। তারাশংকরের উপন্যাসগুলি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এগুলিকে নিয়ে অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে, জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিকও তৈরি হয়েছে। এসব কারনেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তারাশংকর আজও গুরুত্বপূর্ণ।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment