Bengali Bangla Prabandha Rachana বাংলার লোকসাহিত্য ও সমাজজীবন – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বাংলার লোকসাহিত্য ও সমাজজীবন  – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বাংলার লোকসাহিত্য ও সমাজজীবন

ভূমিকা: সমাজ ও সাহিত্যের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। সাহিত্য হল সমাজের আয়না। মানবচরিত্র এবং মানবহৃদয়ের অতলস্পর্শী তলদেশ সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসের বর্ণময় অনুরণন শােনা যায় সাহিত্যের লােকায়ত আঙ্গিকে। এ কারণেই লােকসাহিত্যের গবেষক আশুতােষ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, “প্রত্যেক দেশেই লােকসাহিত্যের ভিত্তির উপরেই লিখিত সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। যদিও লিখিত সাহিত্যধারা সৃষ্টি হইবার সঙ্গে সঙ্গেই মৌখিক প্রচলিত লােকসাহিত্যের ধারাটি ক্রমে শুষ্ক হইয়া যাইতে থাকে, তথাপি বহুকাল পর্যন্ত তাহা একেবারে লুপ্ত হইয়া যাইতে পারে না।” লােকজীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, বিশ্বাস, মূল্যবােধ, আচার-আচরণ প্রভৃতির আশ্চর্য সাক্ষ্য বহন করে লােকসাহিত্য।

লােকসাহিত্যের স্বরুপ ও বাংলা লােকসাহিত্য : আবহমানকাল হতে লােকমুখে প্রচারিত অলিখিত গান, ছড়া, গল্প প্রভৃতিকেই লােকসাহিত্য বলা হয়। এগুলি ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি নয়। প্রাচীন যুথবদ্ধ গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকায় এদের সৃষ্টি। লােকমানসের ধর্ম, সংসার, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চিহ্ন ধারণ করে আছে লােকসাহিত্যের শরীর। মানবজীবনের চিন্তা-চেতনা ও শিল্পবােধের ফসল হল এই লােকসাহিত্য। মানবসভ্যতার গ্রামীণ সংস্কৃতির জটিল উন্মেষ ও উত্থান সমৃদ্ধ সামাজিক অগ্রগতির ইতিহাসের এক আশ্চর্য বহিঃপ্রকাশ লােকসংস্কৃতির মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে। বাংলার বিচিত্র সমাজজীবনের মতােই তার লােকসাহিত্যের ক্ষেত্রটিও বিশাল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। গবেষকেরা এই বিপুল সম্ভারকেলােকচর্যা’, ‘লােকবিজ্ঞান কিংবা লােকশ্রুতি’ নামে অভিহিত করেছেন। যাইহােক লােকসাহিত্যের বিস্তারিত ক্ষেত্রটিতে প্রথমেই আসে লােকসংগীতের বা সংগীতের প্রসঙ্গ। এগুলি স্থান বা অঞ্চলভেদে নানা প্রকারের। যেমন— ঝুমুর, টুসু, ভাদু, পাঁচালি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, সারিগান, জারিগান, কবিগান, বাউল, রামায়ণী গান প্রভৃতি। এই বিভিন্ন ধরনের গানই হল বাংলা লােকসাহিত্যের মর্মবাণী। বাঙালি সংস্কৃতি ও সমাজের সামগ্রিক বিশেষত্ব যেন এই গানগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে। এরপরেই আসে প্রচলিত প্রাচীন ছড়াগুলির কথা।

একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই লােকসাহিত্যের এই গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিকে ছেলেভােলানাে ছড়া সংগ্রহে মনােনিবেশ করেছিলেন। তাঁর মতে এই ছড়াগুলির মতাে প্রাচীন আর কিছুই নেই। শিশুদের জন্য দিদিমা-ঠাকুরমাদের মুখে মুখে প্রচলিত এই ছড়াগুলিতে গ্রামীণ সমাজের নানা দিক ফুটে উঠেছে। লােকজীবনের সামগ্রিক পরিচয়বাহী এই ধরনের ধাঁধা, ছড়া, ব্রতকথা, লােককথা ইত্যাদিই বাংলার লােকসাহিত্যের অমূল্য মণিমাণিক্য। পল্লির লৌকিক জীবনের সামগ্রিক ছবি এই লােকসাহিত্যে বাণীরূপ লাভ করেছে। তাদের জীবন, ভাবনা, বিশ্বাস, ধর্মসংস্কার এসবই ধরা পড়েছে লােকসাহিত্যে। জীবনের সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত যে-শিক্ষা চিরকালীন, মানবজীবনের সেই প্রকৃত শিক্ষার স্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে এইসব ছড়া বা গানে যেমন—

“খােকা ঘুমালাে পাড়া জুড়ালাে বর্গি এল দেশে 
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে।” 

এই ছড়াটিতে বাংলার রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থার ঐতিহাসিক চিত্র প্রতিবিম্বিত হয়েছে। বিশেষ করে বর্গি হাঙ্গামার ভয়াবহতা ও দুর্দশাটি প্রকট। বাংলার লােককথাগুলিতে গল্পরসের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। আর গীতিকাগুলিতে ঘটেছে নাটকীয়তা, কাহিনিধর্মিতা এবং প্রেমমনস্কতার সমাবেশ। গ্রামীণ সমাজে শিক্ষার বিস্তারে এইসব লােকসাহিত্যের অসীম তাৎপর্য ছিল।

উপসংহার: পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘লােকসংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এর গবেষণা ও রক্ষণাবেক্ষণের পথকে সুগম করতে প্রয়াসী হয়েছে। এই লােকসাহিত্য বাঙালির জাতীয় ঐশ্বর্য। একে সর্বতােভাবে রক্ষা করলেই বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণধর্ম ও চরিত্রবৈশিষ্ট্য রক্ষিত হবে।

আরো পড়ুন

আমাদের দেশ – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

তোমার প্রিয় চলচ্চিত্র – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

খেলাধুলা ও ছাত্রসমাজ – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র সমাজের ভূমিকা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

সমাজকল্যাণে ছাত্রসমাজের ভূমিকা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

Read More »

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!