ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষঃ যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি স্থাপন

ষষ্ঠ অধ্যায় (Class VI)

ইতিহাস সাজেশন (ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ)

(যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি স্থাপন)


সূচনা :

     একসময় মানুষ আজকের মত ছিল না। অনেকটা শিম্পাঞ্জির মত। তারা ভালো ভাবে দাঁড়াতে পারত না, গায়ে ছিল বড় বড় লোম আর নখ। আলোচ্য এই অধ্যায়ে আমরা মানুষের আদিম অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনের কথা পড়ব।

২.১ আদিম মানুষের কথা :

     আদিম মানুষ ছিল শিম্পাঞ্জির মত। এদের এপ(Ape) বলা হত। ধীরে ধীরে আবহাওয়া বদলের সাথে সাথে পৃথিবীর পরিবেশেও বদল এল। বাঁদরের মতো গাছে গাছে ঘুরে বেড়ানো মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনল গাছপালা। গাছপালা কমে যাওয়াই ফলে তারা গাছ থেকে মাটিতে নেমে এলো। মানুষ দাঁড়াতে শিখলো। খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল মানুষ। কিন্তু খাদ্যান্বেষণের সাথে সাথে এপ থেকে আলাদা হয়ে গেল মানুষের পরিবার বা হোমিনিড। আদিম যুগের মানুষের জীবন পাথর নির্ভর ছিল। তাই ঐতিহাসিকগণ পাথরের যুগ কে পুরনো পাথরের যুগ, মাঝের পাথরের যুগ ও নতুন পাথরের যুগে ভাগ করেছেন। আগুনের ব্যবহারও ইতিহাসের যুগে এক যুগান্তকারী ঘটনা। বনের দাবানলের ডাল গুহায় এনে মানুষ তা ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে তারা নিজেরাই আগুন জ্বালাতে শিখে যায় পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকি করে। শুধু শীতের হাত থেকে বাঁচতেই নয়, খাবার পুড়িয়ে খেতে জন্তুর মুকাবিলা করতেও আগুন ব্যবহৃত হতে লাগলো। নরম মাংস খেতে খেতে এদের শক্ত চোয়াল শুরু হয়ে গেল। সামনের ধারালো কিছু দাঁত ছোট হয়ে গেল।

আদিম মানুষের নানারকম :

     আদিম কথার অর্থ পুরনো বা গোড়ার দিকে। আদিম মানুষের খোঁজ পাওয়া গেছে পূর্ব আফ্রিকাতে। মূলত মস্তিষ্কের আকার থেকে মানুষের নানা ভাগ করা যায়।

অস্ট্রালোপিথেকাস : এপ থেকে মানুষ

  • এরা ছিল আনুমানিক চল্লিশ লক্ষ থেকে ত্রিশ লক্ষ বছর আগে।
  • এরা দু পায়ে ভরদিয়ে কোনক্রমে দাঁড়াতে পারত।
  • শক্ত বাদাম, শুকনো ফল চিবিয়ে খেতো। চোয়াল ছিল শক্ত ও সুগঠিত।
  • এরা গাছের ডাল দিয়ে ধাক্কা মারত, পাথর ছুঁড়তে চেষ্টা করত।

হোমো হাবিলিস : দক্ষ মানুষ

  • এরা ছিল আনুমানিক ছাব্বিশ লক্ষ থেকে সতেরো লক্ষ বছর আগে।
  • এরা দলবদ্ধ ভাবে থাকত। হাঁটতে পারত।
  • ফলমূলের পাশাপাশি এরা সম্ভবত কাঁচা মাংস খেত।
  • এরাই প্রথম পাথরকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে একটা পাথর দিয়ে আর একটা পাথরকে জোরে আঘাত করে পাথরের অস্ত্র বানাতো।

হোমো ইরেকটাস : সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারা মানুষ

  • এরা ছিল আনুমানিক কুড়ি লক্ষ থেকে তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।
  • এরা দু’পায়ে ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়াতো। দলবদ্ধ ভাবে গুহায় থাকতো।
  • এরা শিকার করতে পারত। এরাই প্রথম আগুনের ব্যবহার শিখেছিল।
  • এরা বানিয়েছিল স্তর কাটা নুড়ি পাথরের হাতিয়ার। সেজদি কে বানিয়েছিল হাত কুঠার।

হোমো স্যাপিয়েন্স : বুদ্ধিমান মানুষ

  • এরা আনুমানিক দুই লক্ষ তিরিশ হাজার বছর আগে এসেছিল।
  • এরা দলবেঁধে বড় পশু শিকার করত। নানা কাজে আগুন ব্যবহার করত। পশুর মাংস পুড়িয়ে খেতো। পশুর চামড়া পড়তো।
  • ছোট, তীক্ষ্ণ ও ধারালো পাথরের অস্ত্র তৈরি করতে শিখেছিল। এরা বর্ষ জাতীয় পাথরের অস্ত্র বানাতে পারত।

একনজরে তিনটি পাথরের যুগ :

পুরনো পাথরের যুগ :

  1. আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব কুড়ি লক্ষ বছর থেকে খ্রিস্টপূর্ব দশ হাজার বছর।
  2. হাতিয়ার বড় ও ভারী পাথরের, এবড়ো খেবড়ো। শিকার করে ও বোনের ফলমূল জোগাড় করে খেত।
  3. খোলা আকাশের নিচে কখনও বা গুহায় থাকতো।

মাঝের পাথরের যুগ :

  1. আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দশ হাজার থেকে খ্রিস্টপূর্ব আট হাজার বছর।
  2. হাতিয়ারের পাথর ছোট হালকা ও ধারালো। শিকার করে ও বনের ফলমূল জোগাড় করার পাশাপাশি পশুপালন শুরু হয়।
  3. গুহা থেকে বেরিয়ে ছোট ছোট বসতি বানানো শুরু হয়।

নতুন পাথরের যুগ :

  1. আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব আট হাজার থেকে খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর।
  2. হাতিয়ার অনেক হালকা ও ধারালো। নানা রকমের হাতিয়ার পশুপালন ও কৃষি কাজ শুরু হয়। মাটির পাত্র বানানো শুরু হয়।
  3. যাযাবর জীবন ছেড়ে একটা অঞ্চলে স্থায়ী বসতি বানানো শুরু হয়।

লুসি :

     আফ্রিকা মহাদেশের ইথিওপিয়ায় হাদার নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে একটা অস্ট্রালোপিথেকাসের কঙ্কালের কিছু অংশ পাওয়া গেছে। কঙ্কালটি প্রায় ৩২ লক্ষ বছর আগের একটা ছোট্ট মেয়ের। কঙ্কালটি নাম দেওয়া হয়েছিল লুসি। লুসির মস্তিষ্ক অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় বেশ বড় ছিল। যদিও ধীরে ধীরে আদিম মানুষের মস্তিষ্ক আরো বড় হতে থাকে।

২.২ ভারতীয় উপমহাদেশে আদিম মানুষ : হাতিয়ার ও জীবন যাপনের নানা দিক

     আফ্রিকা, চীন ও জাভায় প্রাপ্ত পুরনো মানুষের কঙ্কাল ও হাড়গোড় থেকে বোঝা যায় প্রধানত সেখান থেকেই আদিম মানুষ এদেশে এসেছিল।

২.২.১ উপমহাদেশে পুরনো পাথরের যুগ : 

     উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে কাশ্মীরের সোয়ান উপত্যকা পাকিস্তানের পটোয়ার মালভূমি, কর্নাটকের হুন্সগি উপত্যকায়, রাজস্থানের দিদওয়ানা ও মহারাষ্ট্রের নেভাসাতে প্রাচীন মানব দেহের বিভিন্ন চিহ্ন পাওয়া গেছে। এদের ব্যবহৃত হাতিয়ার গুলি আস্তে আস্তে হালকা, ছোট অধারালো হয়ে উঠেছে। ভারি নুড়ি পাথরের হাতিয়ারের ব্যবহার কমতে থাকে। এই সময় মানুষ যাযাবর জীবন যাপন করত।

     শিকার করে ও ফলমূল জোগাড় করেই তারা পেট ভরাতো। মাঝে মাঝে তারা প্রকৃতির গুহায় থাকতো। তারা পশুর চামড়া পড়তো। এদের প্রমাণ আরো পাই উত্তর-পশ্চিমে সাংঘাওতে, কর্নাটকের কুর্ণুল ও মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকায়।

ভীমবেটকা : 

     মধ্যপ্রদেশের ভূপাল থেকে কিছু দূরে বিন্ধ্য পর্বতের গা ঘেঁষে নির্জন জঙ্গলে ১৯৫৭ সালে ভীমবেটকায় বেশকিছু গুহার খোঁজ পাওয়া যায়। এই গলিতে লাল সাদা সবুজ হলুদ রঙের আঁকা নানা ধরনের শিকারের ছবি পাওয়া যায়। এখানে পাখি, মাছ ও কাঠবিড়ালির নানান প্রাণীর ছবি রয়েছে।

হুন্সগি উপত্যকা : 

     ১৯৮৩ সালে কর্নাটকের গুলবর্গা জেলায় উত্তর-পশ্চিমে হুন্সগি উপত্যাকার ইসামপুর গ্রামে প্রায় পাঁচ লক্ষ বা ছয় লক্ষ বছরের পুরনো পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। যেমন – কুড়ুল, ছোরা, চাঁছুনি ইত্যাদি।

ট্যরো ট্যরো :

     ইউরোপের স্পেনে একটি পাহাড়ি এলাকা হলো আলতামিরা। সেখানে কয়েকটি প্রাচীন গুহার খোঁজ পাওয়া যায়। এক প্রত্নতাত্ত্বিক তার ছোট মেয়েকে নিয়ে গুহা গুলি দেখতে গিয়েছিল। তার হাতে একটা আলো ছিল। হঠাৎ ছোট্ট মেয়েটি চিৎকার করে উঠল ট্যরো ট্যরো অর্থাৎ ষাঁড় ষাঁড়। দেখা গেল গুহার ছাদে বিশাল বড় একটা ষাঁড়ের ছবি। এটি প্রায় পঞ্চাশ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগেকার গুহাবাসী মানুষের আঁকা একটি ছবি।

২.২.২ উপমহাদেশের মাঝের পাথরের যুগ :

    মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ বসবাসের জন্য ভালো পরিবেশ তৈরি করল। গাছের ডালের সাথে পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করতে লাগল। উত্তরপ্রদেশের মহাদহা, মধ্যপ্রদেশের আদমগড় প্রভৃতি অঞ্চলে এর নিদর্শন পাওয়া গেছে। এরা এক সময় যাঁতায় শস্য পিষে খেত। আদমগড়ে বন্য পশুর হাড় পাওয়া গেছে। পশুপালনে অভ্যস্ত আদিম মানুষ দুধ রাখার জন্য ঝুড়ির মতো পাত্রে মাটি লেপে নতুন পাত্র বানিয়ে নিত।

বাগোড় :

      রাজস্থানের বাগোড়ে আদিম মানুষের বসতির চিহ্ন পাওয়া গেছে। একেবারে প্রথম দিকে বাগোড়ের বাসিন্দারা শিকার করে খাবার জোটাতো। কিছু কিছু পশুপালনও তাদের জানা ছিল। বাগোড়ে অনেকগুলি পশুর হাড় পাওয়া গেছে। সেগুলো থেকে অনুমান করা হয় পরের দিকে গৃহপালিত পশুর সংখ্যা বেড়েছিল। পাশাপাশি কমতে থাকে শিকার করা পশুর সংখ্যা। অর্থাৎ বাগোড়ের মানুষ ধীরে ধীরে গৃহপালিত পশুর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। সেভাবে দেখলে বাগরে শিকার ও পশুপালন দুই-ই চলত।

২.২.৩ উপমহাদেশে নতুন পাথরের যুগ :

     প্রস্তর যুগে মানুষ হাতিয়ারের অনেক আধুনিকতা এনেছে। মানুষ খাবার তৈরি করতে শিখেছে। কৃষি কাজ শুরু হয়েছে। শস্য উৎপাদনের জন্য মানুষ এক জায়গায় বসতি স্থাপন করেছে। মানুষ কৃষি ছাড়াও কারিগরিবিদ্যা রপ্ত করেছে। এভাবেই বেড়েছে মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। প্রয়োজন মতো জিনিস বানিয়ে মানুষ নিজেই অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করেছে।

অনুশীলনী

প্রশ্ন : আদিম মানুষ যাযাবর ছিল কেন?

প্রশ্ন : আগুন জ্বালাতে শেখার পর আদিম মানুষের কি কি সুবিধা হয়েছিল?

প্রশ্ন : পুরনো পাথরের যুগ বলতে কি বোঝো?

প্রশ্ন : মাঝের পাথরের যুগ কাকে বলে?

প্রশ্ন : নতুন পাথরের যুগ কি?

প্রশ্ন : আদিম মানুষ কেন জোট বেঁধেছিল? এর ফলে তার কি লাভ হয়েছিল?

প্রশ্ন : আদিম মানুষ কিভাবে শস্য উৎপাদন করতে শিখল?

প্রশ্ন : পুরনো পাথরের যুগ ও নতুন পাথরের যুগের মধ্যে প্রধান তিনটি পার্থক্য উল্লেখ করো।

প্রশ্ন : পুরনো পাথরের যুগ ও মাঝের পাথরের যুগের প্রধান তিনটি পার্থক্য লেখ।

প্রশ্ন : মাঝের পাথরের যুগ ও নতুন পাথরের যুগের প্রধান তিনটি পার্থক্য লেখ।

প্রশ্ন : অস্ট্রালোপিথেকাস সম্পর্কে তুমি কি জানো?

প্রশ্ন : হোমো হাবিলিস সম্পর্কে তুমি কি জানো?

প্রশ্ন : হোমো ইরেক্টাস সম্পর্কে তুমি কি জানো?

প্রশ্ন : হোমো স্যাপিয়েন্স সম্পর্কে তুমি কি জানো।

প্রশ্ন : টীকা লেখ : ভিমবেটকা

প্রশ্ন : ট্যরো ট্যরো কি?

প্রশ্ন : লুসি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

প্রশ্ন : দাবানল বলতে কী বোঝো?

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment