ইক্তা প্রথা কী? ইক্তা প্রথার উদ্ভব ও তার বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।

ইক্তা প্রথা কী? ইক্তা প্রথার উদ্ভব ও তার বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে। [৪+8]
অথবাঃ- দিল্লির সুলতানি যুগে ইক্তা ব্যবস্থার পরিচয় দাও।

উত্তর:

ভূমিকা :- মধ্যযুগে ভারতে সুলতানি শাসনকালে ভূমি-রাজস্ব ছিল সম্রাটের আয়ের প্রধান উৎস আদায়কৃত রাজস্ব শাসকশ্রেণির লােকেদের মধ্যে বিতরন করার উপায় হিসেবে এ যুগে নতুন এক প্রথার প্রবর্তন করা হয়। এই প্রথা ‘ইক্তা প্রথা’ নামে পরিচিত। “ইক্তা’ একটি আরবি শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ ‘এলাকা’, বা ‘ অংশ’বা ভাগ’। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব ইক্তা ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন- ইসলামের আইন অনুসারে কৃষকের উৎপন্ন ফসলের উদ্বৃত্তের একটি অংশ কর হিসেবে আদায় করে তা প্রাদেশিক মুসলিম শাসকদের মধ্যে বন্টন করার প্রথাকে ইক্তা প্রথা বলে।

ইক্তা ব্যবস্থা :- সুলতান ইলতুৎমিস খাস জমির বাইরে যে জমি ছিল তা নির্দিষ্ট কতগুলি শর্ত ও কর্তব্য পালনের বিনিময়ে তাঁর সেনাপতি, সৈনিক ও অভিজাতদের পদমর্যাদা অনুসারে বন্টন করে দেন। এটি ইক্তা ব্যবস্থা নামে পরিচিত।

ইক্তাদার :- ইক্তার প্রাপককে ইক্তাদার বা মাকতি বলা হয়। তবে কোনাে কোনাে সময়ে ইক্তাদারকে ‘ওয়ালি’ বলা হত। ইক্তাদার ছিলেন একাধারে রাজস্ব আদায়কারী, সেনাপতি ও সৈন্যদলের বেতন প্রদানকারী।

ইক্তাদারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য :- ইক্তাদার তাঁর প্রাপ্ত ইক্তা থেকে রাজস্ব আদায় ও ভােগ দখলের বিনিময়ে তাঁকে বেশ কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হত। যেমন —

১) সুলতানের প্রয়ােজনের সময় ইক্তাদার সুলতানকে সৈন্য সরবরাহ করতেন।

২) তাঁর নির্দিষ্ট ইক্তা এলাকায় ইক্তাদারকে আইন-শৃঙ্খলা ও কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হত।

৩) ইক্তাভূক্ত কৃষকদের কাছ থেকে প্রাপ্য রাজস্ব বা কর ইক্তাদারদের আদায় করতে হত l আদায়কৃত রাজস্ব থেকে নিজ ব্যয় বাবদ অর্থ বাদ দিয়ে উদবৃত্ত অর্থ সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিতে হত।

ভারতে ইক্তা প্রথা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য :- ভারতে ইক্তা প্রথা প্রবর্তন করে সুলতানরা তাঁদের কয়েকটি উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছেন। যেমন —

১) ভারতে প্রচলিত সামন্তব্যবস্থাকে ধ্বংস করা।

২) ভারতে সুলতানি অধিকৃত এলাকাগুলির উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যকরী নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করা।

৩) আমির-ওমরাহদের সন্তুষ্ট করে সাম্রাজ্যে বিদ্রোহের আশঙ্কা দূরীভূত করা।

৪) রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।

৫) নব বিজিত অঞ্চলগুলির রাজস্ব আদায়ের অনিশ্চয়তা দূরীভূত করতে ইক্তাদারদের নিয়ােগ করা হয়।

ইক্তা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য :- ইক্তা ব্যবস্থা’ ছিল সুলতানি যুগের একটি আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

1) রাজস্ব আদায় : ইক্তাদার তাঁর নির্দিষ্ট ইক্তার কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করলেও কৃষক সমাজ বা জমির ওপর তাঁর কোন ধরনের অধিকার ছিল না l কারন জমি ও কৃষক সমাজ ছিল সুলতানের সম্পত্তি। এমনকি কৃষকদের ওপর রাজস্ব নির্ধারণের ক্ষমতাও ইক্তাদারদের ছিল না ।

২) ইক্তাদারের দায়িত্ব : ইক্তার আদায়কৃত রাজস্ব থেকে ইক্তাদারকে নির্দিষ্ট সৈন্যবাহিনী রাখতে হত। প্রয়ােজনের সময় সুলতানকে সৈন্য সরবরাহ করতে হত।

৩) শাস্তি : ইক্তার আইন-কানুন লঘন করলে সুলতান মাকতিকে কঠোর শাস্তি দিতেন। এমনকি তাঁর ইক্তা বাজেয়াপ্তও করতেন l

৪) সুলতানের ওপর নির্ভরতা : ইক্তাদারের নিয়ােগ, স্থায়িত্ব, বদলি ও পদচ্যুতি সুলতানের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল।

৫) বদলি : ইক্তাদারদের মাঝে মধ্যেই এক ইক্তা থেকে অন্য ইক্তায় বদলি করা হত।

৬) বংশানুক্রমিক : ইক্তা প্রথা বংশানুক্রমিক ছিল না। তবে পরবর্তীকালে তা বংশানুক্রমিক হয়ে পড়েছিল। 

ইক্তা ব্যবস্থার মূল্যায়ন :-

ত্রুটি :- ইক্তা ব্যবস্থার কতকগুলি ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। যেমন —

ক) অধিকাংশ ইক্তাদাররা ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত। সুলতানকে ভুল হিসাব দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করতেন।

খ) ইক্তা ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে সরকারের খাস জমির পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে সুলতানের আয় কমে যায়।

গ) ফিরােজশাহ তুঘলক ইক্তার পদগুলি বংশানুক্রমিক করার ফলে পরবর্তীকালে ইক্তাদাররা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে।

ঘ) সামন্ততন্ত্রের ত্রুটিগুলাে দূর করার জন্য ইক্তাপ্রথা প্রবর্তিত হলেও সামন্ততন্ত্রের ত্রুটিগুলি ইক্তাদারদের মধ্যে সংক্রমিত হয়।

গুরুত্ব :- বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও ইক্তা ব্যবস্থার যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। যেমন- (১) ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে দিল্লির সুলতানরা বিজিত দূরবর্তী অঞ্চলগুলির ওপর আধিপত্য স্থাপন করেন। (২) ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে সুলতানরা প্রশাসনিক ত্রুটিগুলি দূর করে প্রশাসনের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করেন l (৩) ইক্তা বিলি করে সুলতানরা অভিজাত সম্প্রদায়ের অসন্তোষ দূর করে তাদের আনুগত্য লাভ করতে সক্ষম হন। (৪) ইত্তা ব্যবস্থা দিল্লির রাজকোশকে সমৃদ্ধি করেছিল। 

Notice : এই উত্তরে এখানে দুই রকম ভাবে ‘গুরুত্ব’ দেওয়া রয়েছে, তোমরা যেকোনো এক রকম ভাবে লিখেদিবে যেটি তোমাদের ভালো লাগে

গুরুত্ব :- বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্বেও সুলতানি যুগে ভারতে ইক্তা প্রথা প্রবর্তনের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। যেমন- (কৌতুহলী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এই গুরুত্ব অংশটুকু)

১) সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রসার : ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে দিল্লির সুলতানরা ভারতে নতুন নতুন অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ফলে সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটে।

২) দূরবর্তী স্থানের সঙ্গে যােগাযােগ : ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজধানী দিল্লি থেকে সুলতানি সাম্রাজ্যের দূরবর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল।

৩) অভিজাতদের সন্তুষ্টি : বিভিন্ন অভিজাত ও আমির-ওমরাহদের ইক্তা প্রদান করে দিল্লির সুলতানরা তাঁদের অসন্তোষ দূর করতে সক্ষম হন।

৪) প্রশাসনের উৎকর্ষতা : ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে দিল্লির সুলতানরা প্রশাসনের বিভিন্ন ত্রুটি ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে শাসন ব্যবস্থায় উৎকর্ষতা আনেন।

৫) রাজকোশের সমৃদ্ধি : ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব রাজকোশে জমা পড়ে এবং সুলতানের আর্থিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।

      সুতরাং, বলা যায় সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক শাসনের মূল ভিত্তি ছিল ইক্তা ব্যবস্থা । আর সুলতানি সাম্রাজ্যের ভালাে-মন্দের দায় বর্তাত এই ইক্তাদারদের ওপরই।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!