ভারতের দেশপ্রেমের ঐতিহ্য | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ভারতের দেশপ্রেমের ঐতিহ্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ভারতের দেশপ্রেমের ঐতিহ্য

উত্তর:

ভারতের দেশপ্রেমের ঐতিহ্য

“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী” অর্থাৎ জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও মহান। মায়ের প্রতি যেমন, ঠিক তেমনই স্বদেশ অর্থাৎ জন্মভূমির

প্রতিও মানুষ নাড়ির টান অনুভব করে। নিজের দেশ, তা যেমনই হােক-নাকেন, তা আমাদের সকলের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এমন অনুভব থেকেই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছিলেন, “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তমি/সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।” তবে দেশ বলতে যে শুধু একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকেই বোেঝায়, তা নয়। দেশ বলতে প্রধানত ওই নির্দিষ্ট ভৌগােলিক অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষকেই বােঝায়। একটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জনসাধারণের প্রতি সেই দেশের মানুষের যে ঐকান্তিক টান, তাই হল দেশপ্রেম।

বিবিধের মাঝে মহান মিলনের সাধনাই ভারতবর্ষের ঐতিহ্য। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান সত্ত্বেও এ দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে এক ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ। এখানে শক, হন, পাঠান, মােগলো যেমন একদেহে লীন হয়ে গেছে, তেমনি বিভিন্ন জনগােষ্ঠী তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলি অক্ষুন্ন রাখার সুযােগও পেয়েছে। ভাষা, ধর্ম, জাতিগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও এ দেশে সকল মানুষ পরিচিত হয় ভারতীয় রুপে। তাই ভারতের অন্তরের বাণী হল ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।

দেশপ্রেম এমন একটা বিশুদ্ধ আবেগ যে, দেশকে ভালােবেসে প্রাণবিসর্জন দিতেও মানুষ কুণ্ঠা বােধ করে না। বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, দেশকে ভালােবেসে প্রাণ দিয়েছে অসংখ্য মানুষ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনও তার ব্যতিক্রম নয়। ব্রিটিশশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়ে শত শত নির্ভীক ভারতবাসী এগিয়ে গিয়েছে পুলিশের বন্দুকের সামনে। হাসিমুখে গলায় পরেছে ফাঁসির দড়ি। প্রকৃতপক্ষে, প্রাক-স্বাধীনতা পবেই ভারতবাসীর দেশপ্রেম চরমসীমায় উন্নীত হয়েছিল। পরাধীন দেশের কবি যখন বলেন, “ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে,” তখন সেই কথাটিই সাধারণ মানুষের অন্তরে প্রতিধ্বনিত হয়।

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে ভারতের জাতীয় সংহতি কিন্তু কিছুটা শিথিল হয়ে পড়েছে। এর প্রধান কারণ হল ধর্মীয় সংকীর্ণতা। স্বার্থপর এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন কিছু ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতা দেশবাসীর মনে মৌলবাদী মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট হচ্ছেন। ফলে দেশের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ হল ভাষাসমস্যা। বহু ভাষার এই দেশে কয়েকশাে ভাষার মধ্যে মাত্র ২২টি সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এদের মধ্যে ইংরেজি এবং হিন্দি—এই ভাষা দুটি আন্তঃরাজ্য যােগাযােগের ভাষা হিসেবে স্থিরীকৃত হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই হিন্দিকে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির ওপরও চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। ফলে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে উগ্র প্রাদেশিকতার। এ ছাড়াও বর্ণান্ধতা, কুসংস্কার প্রভৃতিও জাতীয় সংহতিকে ব্যাহত করছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে। জনসাধারণ এবং সরকারকে দেখতে হবে, দেশের প্রতিটি মানুষই যেন অন্নবস্তুবাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার যথাযথ সুযােগ পায়। কোনাে ভারতবাসীই যেন তার নিজস্ব ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি চর্চার সুযােগ থেকে বঞ্চিত না হয়। দেশপ্রেম মানুষের মহৎ গুণ হলেও সংকীর্ণ এবং বিদ্বেষপরায়ণ দেশপ্রেম পৃথিবীর বুকে গভীর সংকট নিয়ে আসে। এই ধরনের উগ্র দেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমের অন্তরায়। মানুষ যদি নিজের দেশকে ভালােবাসার সঙ্গে সঙ্গে অন্য দেশের প্রতিও সশ্রদ্ধ মনােভাব পােষণ করে—তবেই তা বিশ্বপ্রেমের সহায়ক হয়। মানুষকে যদি আমরা জাতি-ধর্ম-ভাষা রাষ্ট্রের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে শুধু মানুষ হিসেবেই তাকে বিচার করি, তবেই হতে পারি বিশ্বপ্রেমিক। কবি সত্যেন্দ্রনাথ বলেছেন—“জগৎ জুড়িয়া আছে এক জাতি, সে জাতির নাম মানুষ জাতি এক পৃথিবীর স্তন্যে ললিত, একই রবি-শশী মমাদের সাথী।” এমন ভাবনাই হল বিশ্বমৈত্রী। এই ভাবনাই বলে যে সমগ্র পথিবী হল আমার দেশ। আমি সমগ্র মানবজাতির অংশ। সংকীর্ণ দেশপ্রেম নয়, বিশ্বমৈত্রী-স্নাত দেশপ্রেমই আমাদের কাম্য।

আরো পড়ুন

র‍্যাগিং এবং ছাত্র সমাজ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

এ জীবন চলতে চলতে | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ভ্রমণের মুল্য | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ভারতে অনূধর্ব সতেরাে বিশ্বকাপ ফুটবল | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

শিক্ষায় ও চরিত্রগঠনে খেলাধুলাে | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা

Read More »

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment