ভারতের সংবিধান প্রস্তাবনার গুরুত্ব বা তাৎপর্য আলোচনা করো

উত্তরঃ-

ভুমিকাঃ

সংবিধান হলো কোন দেশের সর্বোচ্চ আইন, প্রস্তাবনা হলো এই সংবিধানের ভূমিকা বা মুখবন্ধ। পৃথিবীর বহু দেশের সংবিধানে শুরুতে একটি প্রস্তাবনা দেখা যায় এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অন্যতম। ভারতের সংবিধানের শুরুতেও একটি প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছে।

প্রস্তাবনার সংজ্ঞাঃ

লিখিত সংবিধানগুলিতে সাধারণত একটি প্রস্তাবনার উল্লেখ দেখা যায়। সাধারণভাবে প্রস্তাবনাকে সংবিধানের মুখবন্ধ বা ভূমিকা বলা হয়। কোনো পুস্তকের ভূমিকায় সেই পুস্তকের উদ্দেশ্যে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা তুলে ধরা হয়। কিন্তু কোনো অবস্থায় সেই মুখবন্ধকে পুস্তকটির মূল অংশ বলা যাবে না। সংবিধানের প্রস্তাবনাটি হল সংবিধানের মুখবন্ধ। এটি সংবিধানের মূল অংশ না হলেও, এর মাধ্যমে সংবিধানের মূল চরিত্র জানা যায়। গোলকনাথ মামলায় রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি সুব্বা রাও বলেছিলেন,–সংবিধানের আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষাকে সংক্ষেপে প্রকাশ করেছে প্রস্তাবনা। তাই পণ্ডিত ঠাকুরদাস বলেছেন, It is a key to the Constitution” অর্থাৎ প্রস্তাবনা হল, – –সংবিধানের চাবিকাঠি।

প্রস্তাবনার স্বরূপঃ

ভারতের মূল সংবিধানে যে প্রস্তাবনাটি ছিল, ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তার কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। বর্তমানে সংবিধানের প্রস্তাবনাটি হল : ভারতের জনগণ নিষ্ঠার সঙ্গে শপথ গ্রহণ করছে যে, তারা ভারতকে একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, সাধারণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলবে। ভারতের সব নাগরিক যাতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, চিন্তা, মত প্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা পায়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হবে।

প্রত্যেকে যাতে মর্যাদা ও সুযোগের সমান সুবিধা পায়, সেদিকে লক্ষ্য দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে যাতে ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুনিশ্চিত হয় এবং মৈত্রীর ভাব বৃদ্ধি পায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে গণপরিষদ ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর এই সংবিধান রচনা ও গ্রহণ করছে।

প্রস্তাবনার গুরুত্ব বা তাৎপর্যঃ

ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার নিম্নলিখিত গুরুত্ব বা তাৎর্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-

১) সংবিধানের উদ্দেশ্য ও নীতির প্রতিফলন :

প্রস্তাবনাকে ভারতীয় সংবিধানের দার্শনিক ভিত্তি বলে অভিহিত করা যায়। কারন সংবিধান-রচয়িতারা যেসব সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল, ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক প্রভৃতি ভাবাদর্শের পাশাপাশি ন্যায়বিচার, সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার সংকল্প ঘোষিত হয়েছে।

২) সংবিধানের অস্পষ্টতা দূরীকরণঃ

সংবিধানে ব্যবহৃত কোনো বাক্য বা শব্দের অর্থ অস্পষ্ট থাকলে তা বোঝার বা ব্যাখ্যার জন্য প্রস্তাবনার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। সংবিধানের অস্পষ্টতা বা দুর্বোধ্যতা দূরীকরণে প্রস্তাবনার এই বিশেষ গুরুত্বের কথা সুপ্রিমকোর্টও বিভিন্ন মামলার রায়দানকালে স্বীকার করে নিয়েছে।

৩) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তাৎপর্যঃ

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। জাতীয় ক্ষেত্রে, সংবিধানের যেসব মৌলিক বিষয় প্রস্তাবনায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, পার্লামেন্ট সহজে সেগুলির সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারেনা। যেমন-

ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রভৃতি। আবার প্রস্তাবনায় ভ্রাতৃত্ববোধ সম্প্রসারণের যে আদর্শের কথা বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। যদিও প্রাচীন কাল থেকেই ভারত এই আদর্শ অনুসরণ করে আসছে।

৪) সামাজিক তাৎপর্যঃ

ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সাধু সংকল্প ঘোষিত হয়েছে। এই সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গ হিসাবে ভারতের সংবিধানে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেনীর জন্য বিশেষ সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা, নারীদের সমান অধিকার, শিশুদের আধিকার, শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রভৃতি সামাজিক ন্যায়ের অসংখ্য আদর্শ ঘোষিত হয়েছে।

৫) নৈতিক গুরুত্বঃ

সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি প্রস্তাবনার নৈতিক গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয়। কারন ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় যেসব মহান আদর্শ ঘোষিত হয়েছে তা যেকোনো দেশের সরকার বা শাসন ব্যবস্থার জন্য হিতকর। কোনো দেশ বা সরকার প্রস্তাবনায় ঘোষিত এইসব মহান নীতি বা আদর্শকে অস্বীকার করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেনা।

মূল্যায়নঃ

পরিশেষে পণ্ডিত ঠাকুরদাস ভার্গব মতানুসারে বলা যায়, প্রস্তাবনা হল সংবিধানের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান অংশ। এটি সংবিধানের আত্মস্বরূপ ও মূল চাবিকাঠি। ভারতের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হিদায়েতুল্লার মতে, প্রস্তাবনা হল সংবিধানের সহযোগী। তবে একথাও সত্যি, প্রস্তাবনায় যেসব মহান আদর্শ বা সংকল্প ঘোষিত হয়েছে তা আজও পুরোপুরি বাস্তবায়িত করা সম্ভব যায়নি।

Read Also

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন | Non-Aligned Movement in Bengali

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment