ভারতের জাতীয় সংহতি – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
উত্তর:
ভারতের জাতীয় সংহতি
ভারতের জাতীয় সংহতি বিবিধের মাঝে মহান মিলনের সাধনাই ভারতবর্ষের ঐতিহ্য। ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান‘ সত্ত্বেও এদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে একটি অখণ্ড ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ। এখানে শক, হুন, পাঠান, মােগলেরা যেমন এক দেহে লীন হয়ে গেছে, তেমনই বিভিন্ন জনগােষ্ঠী তাদের আপন বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রাখার সুযােগ পেয়েছে। ধর্ম, ভাষা, আচারের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও এদেশে অকলে পরিচিত হয়েছে ভারতীয়রূপে। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’– এটাই ভারতের অন্তরের বাণী। জাতীয় সংহতির চেতনা ভারতের অমূল্য সম্পদ। তব কখনাে কখনাে ভারতের এই জাতীয় ঐক্য বা সংহতি শিথিল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, দেশ ও জাতির পক্ষে চরম দুঃসময় ঘনিয়ে আসে।
ভারতবর্ষের জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে প্রথম বড়াে আঘাতটি হানে ইংরেজরা। ইংরেজ শাসনের সূত্রে ভারতবর্ষের বুকে জাতীয়তাবােধ একদিন প্রবল হয়ে উঠেছিল। ইংরেজ তার প্রশাসনিক স্বার্থে এই জাতীয়তাবােধ খণ্ডিত করতে সচেষ্ট হয়। ইংরেজদের চক্রান্তে হিন্দু-মুসলমানের বিরােধ অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং পরিণামে দ্বিখণ্ডিত হয় ভারতবর্ষ। স্বাধীন ভারতেও জাতীয় অসংহতির প্রবণতা একটা বড়াে সমস্যারূপে দেখা দেয়। দিকে দিকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে উগ্র প্রাদেশিকতা। কোথাও কোথাও প্রবল হয়ে ওঠে পৃথক রাজ্যের দাবি। খলিস্তানি আন্দোলন, গাের্খাল্যান্ড আন্দোলন, ঝাড়খণ্ড আন্দোলন, অসম ও ত্রিপুরায় উপজাতিদের আন্দোলন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে জাতীয় সংহতি বিপন্ন হওয়ার লক্ষণ ফুটে ওঠে। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদও জাতীয় সংহতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভাষা, ধর্ম প্রভৃতির ভিত্তিতে বিভিন্ন গােষ্ঠীর মধ্যে যে বিদ্বেষ ও ক্ষোভের প্রকাশ মাঝে মাঝেই ঘটছে, জাতীয় সংহতির পক্ষে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
জাতীয় ক্ষেত্রে অসংহতি দেখা দেওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল ধর্মীয় সংকীর্ণতা। নিজের ধর্মের প্রতি অনুরাগ ও শ্রদ্ধাবােধ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তার পরিণতিতে পরধর্মের প্রতি বিদ্বেষের ফল হয় মারাত্মক। আমাদের দেশে এইরকম ঘটনাই বেশি ঘটে। দায়িত্বজ্ঞানহীন ও প্রকৃত ধর্মবােধহীন কিছু ধর্মীয় নেতা সাধারণ মানুষের। মধ্যে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা জাগিয়ে তােলে। দেখা দেয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। রাজনৈতিক নেতারাও অনেক সময় সাম্প্রদায়িকতাকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলেরও অস্তিত্ব আছে। ভারতের জাতীয় সংহতিতে চিড় ধরার আর-একটি কারণ হল ভাষাসমস্যা। ভারতবর্ষ বহু ভাষার দেশ। প্রত্যেক ভাষাগােষ্ঠীই তার নিজের ভাষার প্রতি দুর্বল। তাই যখন কোনাে ভাষাগােষ্ঠী তার নিজের ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে কোনাে বাধা অনুভব করে, তখনই সে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ভারতে সংস্কৃত ও ইংরেজি ছাড়া আরও ১৪টি আঞ্চলিক ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে। কিন্তু এই ভাষাগুলির মধ্যে যখন কেবল হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মনােনীত করা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই এই নীতির গ্রহণযােগ্যতা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক স্তরে অতিরিক্ত হিন্দিপ্রীতি অন্য ভাষাগােষ্ঠীগুলির মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি করে। বিশেষ কোনাে ভাষার প্রতি কেন্দ্রের অতিরিক্ত মনােযােগ যেমন ক্ষতিকারক, তেমনি সুযােগসুবিধা দানের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনাে প্রদেশের প্রতি পক্ষপাতিত্বও সমানভাবে বিপজ্জনক। এতে প্রাদেশিকতা অনেক সময় উগ্র আকার ধারণ করে। এ ছাড়া বর্ণবৈষম্য, জাতিভেদপ্রথা, নিম্নশ্রেণির প্রতি উচ্চশ্রেণির অমানবিক আচরণ প্রভৃতিও জাতীয় সংহতির পথে অন্তরায়।
জাতীয় সংহতি রক্ষার প্রতি মনােযােগী হওয়া দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই কর্তব্য। প্রতিটি দেশবাসীর মনে যাতে এই কর্তব্যচেতনা সঞ্চারিত হয় তার জন্য সুচিন্তিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। জাতীয় সংহতিকে সুদৃঢ় করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়ােজন এমন একটি জাতীয় শিক্ষানীতি, যা জাতীয়তাবােধের উন্মেষ ঘটাবে। সমগ্র দেশের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যদি সংহতি-চেতনা জাগিয়ে তােলা যায়, তাহলে তা দেশের পক্ষে খুবই মঙ্গলের হবে। এইজন্য পাঠক্রমে এবং অন্যান্য সহপাঠক্রমিক কাজকর্মে সংহতি-চেতনার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া বিভিন্ন সমাজ-সংগঠন ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকেও সংহতি রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যােগাযােগ, জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক। তাই সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষ থেকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। খেলাধুলা ও অন্যান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে আন্তঃরাজ্য যােগাযােগকে আরও সুদৃঢ় করে তুলতে হবে। জাতীয় স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন ধর্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরও। এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বই বােধহয় সবচেয়ে বেশি। দেশের প্রতিটি প্রদেশের প্রতিটি মানুষ যাতে তার নিজস্ব ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিচর্চার পর্যাপ্ত সুযােগ পায়, সেদিকে সরকারের সজাগ দৃষ্টি থাকা প্রয়ােজন। প্রকৃত শিক্ষার অভাব থেকেই অনেক সময় মানুষ অন্য ধর্ম, ভাষা বা জাতির প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তাই সমগ্র দেশজুড়ে চাই প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার।
ভারতবর্ষ চিরকালই মিলনের পক্ষে। যুগে যুগে এদেশের মহাপুরুষগণ শুনিয়ে গেছেন মহামিলনের বাণী। তাই বিচ্ছিন্নতাবােধ এদেশে কখনােই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা বা অন্য কোনাে বিষয়কে কেন্দ্র করে যে অশুভ শক্তি মাঝে মাঝে জাতীয় সংহতিকে বিপন্ন করে তােলে, তা একদিন ভারতবর্ষের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। কেননা এদেশের ঐতিহ্যে বিচ্ছিন্নতা নয়, চিরকাল ঐক্যের সুরই ধ্বনিত হয়েছে।
আরো পড়ুন
অবকাশযাপন | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
উন্নয়ন বনাম পরিবেশ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
প্রয়াত বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখােপাধ্যায় – জীবনীমূলক প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞাপন ও আধুনিক জীবন | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
দেশপ্রেম বনাম বিশ্বপ্রেম | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।