ভারতের গণপরিষদের গঠন ও কার্যাবলী

উত্তরঃ-

গণপরিষদ গঠনের পটভূমিঃ

স্বাধীন ভারতের জন্য সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল। গণপরিষদ যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম সংবিধান রচনা করেছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। তাই অধ্যাপক জোহারী বলেছেন, “গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান রচনা বর্তমান শতাব্দীতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।”

এই গণপরিষদের দাবি ১৯২২ সালে মহাত্মা গান্ধি প্ৰথমে তুলেছিলেন। তাঁর দাবি অনুসারে জাতীয় কংগ্রেস গণপরিষদ গঠনের জন্য সোচ্চার হয়। প্রথমদিকে ব্রিটিশ সরকার এই দাবিকে উপেক্ষা করে। কিন্তু ১৯৪৬ সালে ব্রিটেনে শ্রমিক সরকার ক্ষমতায় এলে, তারা ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দেবার জন্যে তার রূপরেখা তৈরি করতে ক্যাবিনেট মিশন পাঠায়।

এই মিশন ভারতে এসে একটি প্রস্তাব পেশ করে। সেই প্রস্তাবের বক্তব্য ছিল:

(ক) গণপরিষদ সংবিধান তৈরি করবে।

(খ) প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যরা গণপরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করবে।

(গ) হিন্দু, মুসলমান ও শিখরা নিজেদের সংখ্যা অনুযায়ী প্রতিনিধি পাঠাবে।

(ঘ) দেশীয় রাজ্যগুলি প্রতিনিধি পাঠাবে।

এই প্রস্তাব গৃহীত হলে গণপরিষদ গঠনের পথ প্রশস্ত হয়। 

গণপরিষদের গঠনঃ

ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্যে গণপরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের মোট সদস্য হয় ৩৮৯ জন। এর মধ্যে প্রদেশগুলির আইনসভা থেকে নির্বাচিত হন ২৯২ জন। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এরা নির্বাচিত হন। এই ২৯২ জনের মধ্যে মুষলমানদের জন্যে ৭৮টি আসন, শিখদের জন্যে ৪টি এবং

সাধারণের জন্যে ২১০টি আসন সংরক্ষিত হয়। ৪ জন সদস্য আসেন চীফ কমিশনার শাসিত প্রদেশগুলি থেকে। এ ছাড়া ৯৩ জন প্রতিনিধি এলেন দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে গণপরিষদের নির্বাচনে দলগত বিচারে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ২৯২টি প্রাদেশিক আসনের মধ্যে কংগ্রেস লাভ করে ২০৮টি আসন। ৯টি ব্যতীত সাধারণ সবকটি আসন পায় কংগ্রেস।

মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ৭৮টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ৭৩টি আসন লাভ করে।

গণপরিষদের কার্যাবলি/ভূমিকাঃ

বিভিন্ন অধিবেশনের মাধ্যমে গণপরিষদের কার্যাবলি সম্পাদিত হয়। এই কার্যাবলির মধ্যে দিয়ে গণপরিষদ ভার ভূমিকা পালন করে।

(ক) প্রথম অধিবেশন : ১৯৪৬ সালে ৯ই ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। মুসলিম লিগের সদস্যরা প্রথমে পাকিস্তান গঠনের দাবিতে এই অধিবেশন বয়কট করে। ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ পরিষদের স্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হন। এই অধিবেশনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি গঠিত হয়। এর নাম সভার কার্য বিবরণী সম্পর্কিত কমিটি। গঠনের পরের দিন জওহরলাল নেহরু ভারতকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাধারণতন্ত্র হিসাবে উল্লেখ করে একটি প্রস্তাব আনলে তা অনুমোদিত হয়।

(খ) দ্বিতীয় অধিবেশন : ১৯৪৭ সালে ২০শে জানুয়ারি পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে কয়েকটি কমিটি গঠিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল,-কার্যনির্বাহ কমিটি, মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত কমিটি, সংখ্যালঘু সম্পর্কিত কমিটি প্রভৃতি।

(গ) তৃতীয় অধিবেশন : তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয় ১৯৪৭ সালে ২২শে এপ্ৰিল৷ এই অধিবেশনে বিভিন্ন কমিটির রিপোর্ট পেশ করা হয় এবং সেগুলির উপর আলোচনা হয়। তাছাড়া, এই অধিবেশনে সংবিধান সম্পর্কিত দুটি কমিটি গঠিত হয়। একটি হল কেন্দ্রীয় সংবিধান কমিটি। অন্যটি হল প্রাদেশিক সংবিধান কমিটি।

(ঘ) চতুর্থ অধিবেশন : ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুলাই পরিষদের চতুর্থ অধিবেশন বসে। এই অধিবেশন স্থায়ী হয় ৩১শে জুলাই পর্যন্ত। ২২শে জুলাই ভারতের পতাকার পরিকল্পনা স্থির করা হয়। বিভিন্ন কমিটির রিপোর্ট নিয়ে এই অধিবেশনে আলোচনা শুরু হয়। মৌলিক অধিকার, সংখ্যালঘু উপজাতি প্রভৃতি সম্পর্কিত পরামর্শদাতা কমিটিগুলির প্রতিবেদন এই অধিবেশনে পেশ করা হয়।

ঙ) পঞ্চম অধিবেশন : গণপরিষদের অধিবেশন চলাকালীন ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালে ৩রা জুন ঘোষণা করলেন, ব্রিটেন ১৫ আগস্ট, ভারত ও পাকিস্তান-এই দুটি রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। সেইমত দুটি দেশের জন্যে পৃথক গণপরিষদ সংবিধান রচনা করবে। এই ঘোষণামত ১৯৪৭ সালে ১৪ই আগস্ট মধ্যরাত্রে ভারতের গণপরিষদের বিশেষ, অধিবেশন বসে। সেই অধিবেশনে গণপরিষদকে সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়। জওহরলাল নেহরুকে প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ভারতের জন্য একটি খসড়া সংবিধান তৈরির উদ্দেশ্যে ২৯শে আগস্ট ডঃ আম্বেদকরের সভাপতিত্বে একটি খসড়া কমিটি (Drafting Committee) গঠিত হয়।

১৯৪৮ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের কাছে খসড়া সংবিধান পেশ করা হয়। প্রায় তিন বছর ধরে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের শেষে ১৯৪১ সালে ২৬শে নভেম্বর গণপরিষদে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়। এই সংবিধানে ৩৯৫ টি ধারা ও ৮টি তফশিল উল্লিখিত হয়। ১৯৫০ সালে ২৬শে জানুয়ারি এই সংবিধান চালু হয়। 

মূল্যায়ন: সমালোচিত হলেও এ কথা অনস্বীকার্য, ভারতের সেই সময়কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পটভূমিতেও এর কোনো বিকল্প ছিল না। গ্রেনভিল অস্টিন (Austin) বলেছেন, – সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে সংবিধান রচনায় বিলম্ব হত। ভাতে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারত। তাছাড়া, ভারতের সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ কাশ্যপ তাঁর লেখা Our Constitution গ্রন্থে বলেছেন,-সেই সময় ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের আধিপত্য সম্পর্কে কোনো বিতর্কের অবকাশ ছিল না। বরং তাদের এই আধিপত্যের জন্যে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি সংবিধান রচনায় বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে এত অল্প সময়ে শান্তিপূর্ণভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম সংবিধান রচনা করে গণপরিষদ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে।

Read Also

ভারতের সংবিধান প্রস্তাবনার গুরুত্ব বা তাৎপর্য আলোচনা করো

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন | Non-Aligned Movement in Bengali

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment