ভূমিকা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারতে জাতীয় আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই পারস্পরিক বিরোধ ভুলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। আর এই উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করার জন্য ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে লখনৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতােপূর্বে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বােম্বাই (মুম্বাই)-তে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ একসুরে ব্রিটিশ সরকারের বিবিধ নীতির সমালােচনা করে এই চুক্তির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
লখনৌ চুক্তির শর্তাবলি : ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের লখনৌ অধিবেশনে নরমপন্থী ও চরমপন্থী গােষ্ঠীর মধ্যেকার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। একদিকে ঐক্যবন্ধ কংগ্রেস এবং অপরদিকে
মুসলিম লিগ পরস্পরের অনেকটা কাছে চলে আসে। এক্ষেত্রে বাল গতাধর তিলক এবং মহম্মদ আলি
জিন্নার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। চরমপন্থী হিসেবে পরিচিত তিলক নরমপন্থীদের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট হন। এ ছাড়া তিনি আন্তরিকভাবে হিন্দু-মুসলিম বিভেদের অবসানও চেয়েছিলেন। অন্যদিকে মুসলিম লিগের নেতারাও বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ।
লখনৌ চুক্তির মূল কথা ছিল —প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, বিকেন্দ্রীকরণ, ভারতীয়করণ ইত্যাদি। জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের যৌথ উদ্যোগে গঠিত এই শর্তগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল-
- পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে জাতীয় কংগ্রেস মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বের দাবিগুলি মেনে নেবে।কংগ্রেসের স্বরাজ্যের দাবিকে মুসলিম লিগ সমর্থন করবে।
- কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ হবে মুসলিম প্রতিনিধি।
- তবে সংরক্ষিত আসন ছাড়া মুসলমানরা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক অন্য কোনাে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারত না।
- ভারত-সচিবের দুজন সহকারীর মধ্যে একজন হবেন ভারতীয়।
- ভারত-সচিবের বেতন বহন করবে ব্রিটিশ সরকার।
- ডােমিনিয়নের মর্যাদা ও প্রতিনিধিত্ব ভারতকেও দিতে হবে। ও সামরিক বাহিনীতে ভারতীয়দের নিয়ােগ করার দাবি তােলা হয়।
লখনৌ চুক্তির গুরুত্ব: ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের লখনৌ চুক্তি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টি-করেছিল। এই চুক্তির বাস্তবায়ন প্রমাণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাদের যৌথ আন্দোলন কোনাে কাল্পনিক-ভাবনাচিন্তা নয়। ঐতিহাসিক বিধান চন্দ্র-এর মতে, লখনউ চুক্তি হল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
এই চুক্তির গুরুত্বগুলি হল —
- এই চুক্তির দ্বারা অল্প সময়েই হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল। এই চুক্তি স্বাক্ষর করে বাল গঙ্গাধর তিলক এবং মােহম্মদ আলি জিন্নার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়।
- লখনৌ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়ে ওঠায় জনমানসে এর সদর্থক প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্যাপক উদ্দীপনার সঞর ঘটে।
- লখনৌ চুক্তির দ্বারা গড়ে ওঠা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সুফল খিলাফত আন্দোলনে ও দেখতে পাওয়া যায়। ওই আন্দোলনে হিন্দুরা কিন্তু মুসলমানদের সমর্থন জানিয়েছিল। গান্ধিজি স্বয়ং খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন।
- অপরদিকে অসহযােগ আন্দোলনেও প্রচুর মুসলমান অংশ ও লখনৌ চুক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা হিন্দু মুসলমানদেরঐক্যে ব্রিটিশ সরকার চিন্তা করতে থাকে।
উপসংহার : লখনৌ চুক্তি সার্বিকভাবে ভারতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গঠন করতে পারেনি। মুসলিমদেরজন্য পৃথক নির্বাচন নীতি মেনে নিয়ে কংগ্রেস ঠিক করেনি বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন।রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর মতে, লখনৌ চুক্তি ছিল কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। এই চুক্তির দ্বারা যুক্তপ্রদেশের মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার জন্য বাংলা ও পাঞ্জাবের মুসলিমদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করা হয়। ড, অমলেশ ত্রিপাঠী-র মতে, এই চুক্তি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রসারে সহায়ক ছিল না। লখনৌ চুক্তি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও এর দ্বারা পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকে যায়।
Read Also
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে। এই আইনের ত্রুটিগুলি উল্লেখ করাে ?
লখনৌ চুক্তির শর্তাবলি উল্লেখ করাে। এই চুক্তির গুরুত্ব আলােচনা করাে?
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড এর প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব আলোচনা করো
সমাজসংস্কার আন্দোলনে বিদ্যাসাগর এর ভূমিকা আলােচনা কর ?
নতুন সামাজিক ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য আলােচনা কর। অথবা, নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব লেখাে।
টীকা লেখাে: পরিবেশ ইতিহাস চর্চা। অথবা, পরিবেশ ইতিহাস চর্চা গুরুত্বপূর্ণ কেন?
বঙ্গদর্শন পত্রিকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব লেখাে। অথবা, টীকা লেখাে: বঙ্গদর্শন
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।
good 👍 answered
নৌ বিদ্রোহ class 12
Good answer
Thank you so much, this is very helpful ☺