নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের জীবনযাত্রার পরিচয় দাও। এই যুগের গুরুত্ব কী ? অথবা, নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করো।

নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের জীবনযাত্রার পরিচয় দাও। এই যুগের গুরুত্ব কী ?

অথবা, নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করো।

উত্তর:

মানবসমাজের বিবর্তনের ইতিহাসে নব্য প্রস্তর যুগ ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির শেষ পর্যায় ছিল নব্য প্রস্তর যুগ। মধ্যপ্রস্তর যুগের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা হয়। ৫০০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এই যুগের সূচনা হয়েছিল। এই যুগে আদিম মানবের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল, যা এই যুগের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়-

(১) হাতিয়ার: নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের তৈরি হাতিয়ারগুলি ছিল উন্নত, ধারালাে ও হাতলযুক্ত। এই যুগের মানুষ মাটি কাটার জন্য কোদাল, গাঁইতি, ফসল কাটার জন্য কাস্তে, হামানদিস্তা, শিলনােড়া, জাঁতা, বাটালি, হাতুড়ি প্রভৃতি কৃষি উপযােগী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করত। নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ তিরধনুক তৈরি করতে শেখে। এটাই বােধহয় মানুষের প্রথম যন্ত্র আবিষ্কার।

(২) জীবিকা: নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ শিকার করলেও খাদ্যের জন্য শিকারের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল না। তারা খাদ্য উৎপাদন করতে শেখে।

  • কৃষিকাজ: নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ কৃষি কাজের কৌশল আবিষ্কার করে। প্রথমে তারা যবের চাষ শুরু করে। ফলে খাদ্যের অনিশ্চয়তা দূর হয় এবং মানুষ খাদ্য উৎপাদন করতে শেখে। এই যুগে কৃষিজাত ফসলের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল যব, গম, ভুট্টা, খেজুর প্রভৃতি।
  • পশুপালন: এই সময়ে কৃষির প্রয়ােজনে মানুষ পশু পালন করতে শেখে। পশুকে কৃষিজমিতে কাজে লাগিয়ে কৃষির উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি করে। পরিবহনের কাজেও পােষ মানানাে পশুকে কাজে লাগানাে শুরু হয়। গরু, মহিষ, ছাগল, কুকুর প্রভৃতি পশু এই যুগে তারা পালন করত।

(৩) স্থায়ী বাসস্থান তৈরি: নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ কৃষির প্রযােজনে ফসলের ক্ষেতের ধারে গাছের ডালপালা, লতাপাতা দিয়ে কুটির বা গৃহ নির্মাণ শুরু করে। এর ফলে তাদের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে এবং বসত অঞ্চলগুলি ধীরে ধীরে গ্রামে পরিণত হয়।

(৪) আবিষ্কার ও অন্যান্য অগ্রগতি: নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ কৃত্রিম আগুন তৈরীর কৌশল আবিষ্কার করে। কুমােরের ‘চাকা’ আবিষ্কার করে মৃৎশিল্পের উন্নতি ঘটায়। পাথর সাজিয়ে সমাধি মন্দির নির্মাণ করে। কাপড় বুনতে শেখে, আগুনে পােড়ানাে মৃৎপাত্র তৈরীর কৌশল আবিষ্কার করে। এই যুগের শেষের দিকে মানুষ ধাতুর ব্যবহার করতে শেখে, এককথায় অন্যান্য প্রস্তর যুগের তুলনায় নব্য প্রস্তর যুগের অগ্রগতি ও প্রাপ্তি ছিল অনেক বেশি। নব্য প্রস্তর যুগের এই অভাবনীয় অগ্রগতি লক্ষ্য করে গবেষক গর্ডন চাইল্ড একে ‘নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন।

(৫) রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা: নব্য প্রস্তর যুগে রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম হয়। গােষ্ঠীগুলি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে গােষ্ঠীর নেতার পদটিও স্থায়ী হয়। কৃষিজমি ও পশু নিয়ে গােষ্ঠীগুলির মধ্যে বিবাদ লেগেই থাকত। ফলে গােষ্ঠীর জয়লাভের জন্য গােষ্ঠীর নেতা গােষ্ঠীর ওপর বিভিন্ন নিয়ম-কানুন চাপিয়ে দিত। ফলে একটি প্রশাসনিক কাঠামাের সৃষ্টি হয়।

(৬) শ্রমবিভাজন: নব্য প্রস্তর যুগে নারী ও পুরুষের শ্রম বিভাজন তৈরি হয়। পুরুষরা হাতিয়ার তৈরি, শিকার, পশুপালন ও গৃহ নির্মাণের কাজ করত। অপরদিকে মহিলারা কৃষিকাজ, কাপড় বােনা, মাটির পাত্র নির্মাণ, গৃহস্থলীর কাজ ও সন্তান পালন করত।

(৭) ভাষার উন্নতি: নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের মধ্যে মেলামেশা বৃদ্ধি পায়। সামাজিক সম্পর্ক ও ভাববিনিময়ের ফলে ভাষার উন্নতি ঘটে। সেমেটিক, হেমেটিক প্রভৃতি ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষার জন্ম এই যুগেই হয়।

(৮) ধর্মবিশ্বাস: প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নব্য প্রস্তর যুগের আদিম মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে দেবতা হিসেবে পূজা করা শুরু করে। পাথর কেটে দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ এই যুগেই শুরু হয়। মেসােপটেমিয়া ও ক্রিটে এইরকম দেবদেবীর মূর্তির নিদর্শন পাওয়া গেছে।

গুরুত্ব: মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় নব্য প্রস্তর যুগ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন প্রস্তর যুগ ও মধ্য প্রস্তর যুগের থেকে নব্য প্রস্তর যুগের সময়কাল অনেক কম হলেও এই যুগে মানব সভ্যতার বেশ কিছু উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি ঘটে। যেমন:-

(ক) মানব সমাজের চরিত্রগত পরিবর্তন: নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ কৃষিকাজ ও পশুপালন করার কৌশল আবিষ্কার করে। ফলে খাদ্য সংগ্রহকারী মানুষ খাদ্য উৎপাদন করতে শেখে।

(খ) হাতিয়ারের উন্নতি: নতুন পাথরের যুগের মানুষ মসৃণ ধারালাে হাতলযুক্ত হাতিয়ার নির্মাণ করে। ফলে হাতিয়ারগুলির কার্যকারিতাও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

(গ) নতুন আবিষ্কার: এই যুগে মানুষ কৃত্রিম আগুন, চাকা, চাকাযুক্ত গাড়ি, পালতােলা নৌকা, কাপড় বােনার কৌশল, আগুনে পােড়া মৃৎপাত্র তৈরীর কৌশল আবিষ্কার করে।

(ঘ) ভাষার ব্যবহার: নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক ও বিনিময় প্রথার ব্যাপকতার ফলে ভাব বিনিময়ের প্রয়ােজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ক্রমে ভাষার উন্নতি ঘটে।

(ঙ) স্থায়ী বাসস্থান: নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করে, ফলে যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে।

(চ) রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্রম: স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠার পর গােষ্ঠীপতি ধীরে ধীরে শাসকে পরিণত হয়। সামাজিক সংগঠন হিসেবে এই সময় পরিবারের উদ্ভব ঘটে। এই সমাজে পেশা ভিত্তিক বিভিন্ন শ্রেণীর উদ্ভব হয়।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment