হরপ্পা সভ্যতার নগর জীবনের উপর একটি টীকা লেখ। এই সভ্যতার পতনের কারণগুলি কি ছিল ?

হরপ্পা সভ্যতার নগর জীবনের উপর একটি টীকা লেখ। এই সভ্যতার পতনের কারণগুলি কি ছিল ?

অথবা, হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বর্ণনা দাও। এই সভ্যতার পতন কেন হয় ?

উত্তর:

হরপ্পা সভ্যতা ভারতবর্ষের প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। হরপ্পাবাসী এক উন্নত নাগরিক পরিবেশে আধুনিক জীবন যাপন করত। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, কালিবঙ্গান ও লােথাল প্রভৃতি প্রতিটি কেন্দ্রেই উন্নত নাগরিক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এই ধ্বংসাবশেষ থেকে হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার চিত্রটি সহজেই অনুমান করা যায়।

ক) দূর্গ: প্রত্যেকটি নগর দূর্গ দ্বারা বেষ্টিত ছিল। উঁচু ঢিবির উপর দুর্গ নির্মাণ করা হত। শাসক শ্রেণীর লােকেরা দুর্গের অভ্যন্তরে বসবাস করতেন আর নগর দুর্গের নিচে অবস্থিত উপনগরীতে সাধারণ মানুষের বসবাস ছিল।

খ) রাস্তাঘাট: প্রশস্ত, সােজা এবং পরিচ্ছন্ন রাজপথ হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রধান রাস্তাগুলি 9 ফুট থেকে 40 ফুট পর্যন্ত চওড়া, পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণে সমান্তরাল। গলিপথগুলি ছিল বড় রাস্তার সঙ্গে সংযুক্ত। রাস্তার দুধারে আলােকস্তম্ভ, বাঁধানাে ফুটপাথ ও ডাস্টবিন ছিল। পাথর, চুন-সুরকি দিয়ে রাস্তাগুলি তৈরি করা হয়েছিল। 

গ) ঘরবাড়ি: হরপ্পা সভ্যতার বাড়ি গুলি ছিল পোড়া ইটের তৈরি। অধিকাংশ বাড়িই ছিল দোতলা বা তিন তলা। প্রতিটি বাড়ি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রশস্ত উঠান, কুয়ো, স্নানাগার, রান্নাঘর, সােকপিট প্রতিটি বাড়িতেই ছিল।

ঘ) পয়ঃপ্রণালী: উন্নত পয়ঃপ্রণালী ছিল হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক বাড়িতে ব্যবহৃত জল, বৃষ্টির জল, রাস্তার ধারে নর্দমায় এসে পড়তাে। কোথাও ইট, কোথাও পাথরের ঢাকনা দিয়ে নর্দমাগুলি ঢাকা থাকতাে। নর্দমাগুলিতে যাতে পলি পড়ে বা আবর্জনা পড়ে মজে না যায় তার জন্য ম্যানহােল দিয়ে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা ছিল। এই সভ্যতার জল নিকাশি ব্যবস্থা ছিল সত্যিই চমকপ্রদ। এইজন্য অধ্যাপক ব্যাসাম যথার্থই বলেছেন যে, রোমান সভ্যতার আগে এত উন্নত পয়ঃপ্রণালী আর কোন সভ্যতায় ছিল না।

ঙ) স্নানাগার ও শস্যাগার: নির্মাণ শৈলীর দিক থেকে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হল মহেঞ্জোদারোর স্নানাগার ও হরপ্পার শস্যাগার। মহেঞ্জোদারোর বিশালাকার স্নানাগারটির আয়তন ছিল 180×108 ফুট, স্নানাগারের অভ্যন্তরে অবস্থিত জলাশয়ের আয়তন ছিল দৈর্ঘ্যে 39 ফুট, প্রস্থে 23 ফুট এবং গভীরতায় 8 ফুট। জলাশয়টির চারিদিকে 8 ফুট উচ্চতার প্রাচীর ছিল। জলাশয় টিতে ওঠানামার জন্য সিঁড়ি ছিল। অনুমান হয়, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে স্নানাগার টি ব্যবহৃত হত। ঋতুভেদে জল ঠান্ডা ও গরম করার ব্যবস্থা ছিল। নােংরা দূষিত জল বের করার জন্য নর্দমা ছিল। হরপ্পায় যে শস্যাগারের নিদর্শন পাওয়া গেছে তার আয়তন ছিল দৈর্ঘ্যে 169 ফুট এবং প্রস্থে 135 ফুট। একটি উঁচু মঞ্চের ওপর এই শস্যাগারটি তৈরি করা হয়েছিল । শস্যাগারের সামনে একটি বিরাট চাতালে শস্য ঝাড়াই-মাড়াই হত। শস্যাগারের পাশেই শ্রমিকদের বাসস্থান ছিল। অধ্যাপক ব্যাসাম এই শস্যাগারটিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখানে আপৎকালীন সময়ের জন্য খাদ্যশস্য মজুত থাকত।

চ) পৌরব্যবস্থা: নগর বিন্যাসের পদ্ধতি দেখে মনে হয়, সৌরব্যবস্থা ছিল খুব উন্নত। নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। রাত্রিতে পথিকের সুবিধার জন্য আলাের ব্যবস্থা করা হত। জলনিকাশি, আবর্জনা পরিষ্কার, পানীয় জলের ব্যবস্থা তার ইঙ্গিত দেয়। তবে এই শাসনব্যবস্থা রাজতান্ত্রিক না গণতান্ত্রিক ছিল সে বিষয়ে বিতর্ক আছে।

মূল্যায়ন: হরপ্পা সভ্যতার উন্নত নগর পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ওপর লক্ষ্য করেই। তার ফলে হরপ্পার অধিবাসীরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে পারত। হরপ্পার উন্নত নগর পরিকল্পনা সমগ্র বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলির কাছে এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। 

ধ্বংসের কারণ: প্রামান্য তথ্যের অভাবে সিন্ধু সভ্যতার উত্থানের মতাে পতনের কারণ সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানা যায় না। তবে ঐতিহাসিকরা তাদের মতামতের ভিত্তিতে প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক- বিশেষত বৈদেশিক আক্রমণকেই পতনের সম্ভাব্য কারণ বলে মনে করেছেন, যেমন:-

(১) প্রাকৃতিক কারণ:- হরপ্পা সভ্যতার পতনের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে এম. আর. সাহানি, রাইকেস, ডেইলস প্রমুখ ঐতিহাসিকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপকে চিহ্নিত করেছেন। বস্তুত সিন্ধু নদীতে ক্রমাগত বন্যা দেখা দেওয়ায় এই সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটে।

  • অনেকে অনুমান করেন যে, মহেঞ্জোদারাের কাছে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে এরফলেই সভ্যতা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়।
  • হরপ্পা সভ্যতার পতনের সবচেয়ে প্রচলিত মতটি হল প্রাকৃতিক পরিবেশের আকস্মিক পরিবর্তন কার্যত বৃষ্টিপাতের পরিমাণের মাত্রা হ্রাস পাওয়ায় উর্বর কৃষি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়।

(২) আর্থসামাজিক কারণ: 

  • বৈদেশিক আক্রমণ: এম ট্যাডি, হুইলার প্রমুখ ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন বিদেশী জাতির আক্রমণের ফলে এই সভ্যতার বিনাশ ঘটেছিল বলে মনে করেন। এই আক্রমণকারীদের অনেকেই ‘বৈদিক আর্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
  • পৌর কর্তৃপক্ষের অপদার্থতা:- অনেক ঐতিহাসিক হরপ্পা সভ্যতার পতনের জন্য নগর কর্তৃপক্ষের অপদার্থতা ও নাগরিকদের চারিত্রিক অবনতিকে দায়ী করেছেন। হরপ্পা সভ্যতার শেষের দিকে পৌর প্রশাসনের দুর্বলতা এবং নাগরিকদের স্বৈরাচার এই সভ্যতার পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তােলে।

পরিশেষে বলা যায়, সভ্যতার পতনের মূলে বিভিন্ন কারণের সমাবেশ ঘটেছিল। তবে, সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার বিলুপ্তির রহস্য সঠিকভাবে উদঘাটন করা সম্ভব নয়।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!