পরিবেশের সংকট ও সমস্যা সম্পর্কে আলােচনা কর

পরিবেশের সংকট ও সমস্যা সম্পর্কে আলােচনা কর Class 12 | Sociology (সাম্প্রতিক কালের সামাজিক বিচার্য বিষয়) | 8 Marks

উত্তর:

বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে এই গ্রহে কোটি কোটি বছর ধরে বসবাস করে আসছে। পরিবেশের আনুকূল্যের সুবাদে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর উদ্ভব, বিবর্তন ও সমৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। পৃথিবীর পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে পড়লে কোনাে প্রাণীর পক্ষেই অস্তিত্ব অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। ও মানুষের অপরিণামদর্শিতা, একদেশদর্শী ধ্যান-ধারণা ও কর্মকাণ্ড, অথবা অজ্ঞতার কারণে পরিবেশের তা বিপর্যস্ত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। পরিবেশের সম্পদসমূহ সীমিত। তার পরিমাণ, মান ও

ভারসাম্যের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। মুষ্টিমেয় মানুষের মারাত্মক অজ্ঞানতা-অবহেলার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণের প্রাত্যহিক অজ্ঞতা ও বদভ্যাস প্রসূত হঠকারী সিদ্ধান্তসমূহ পরিবেশের অবক্ষয় ও বিপর্যয় অনিবার্য করে তুলছে। সুদীর্ঘকাল ধরে প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের অপব্যবহারের কারণে পরিবেশ ও জনজীবনে সংকট সৃষ্টির আশংকা দেখা দিয়েছে। 

পরিবেশের সংকট ও সমস্যা (Environmental Crisis and Problems)

পৃথিবীব্যাপী পরিবেশের সমস্যা বহু ও বিভিন্ন। দেশ-কাল ভেদে এই সমস্যা পরিবর্তন হয়। তবে কতকগুলি পরিবেশ-সমস্যা পৃথিবীব্যাপী সাধারণভাবে স্বীকৃত।

(১) সম্পদ নিঃশেষিতকরণ : সাম্প্রতিককালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ-সমস্যা হল প্রাকৃতিক সম্পদের নিঃশেষিতকরণ। অধিকাংশ প্রাকৃতিক সম্পদই ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে নিঃশেষিত হয়ে যায়; পুনরায় ব্যবহারযােগ্য করা যায় না। সাধারণত পেট্রোলিয়ম কয়লার মত জীবাশ্ম জ্বালানীর পরিমাণ সীমিত। অধিক এবং অপরিমিত ব্যবহারের ফলে এই সম্পদে নিঃশেষিতকরণের আশংকা ঘনীভূত। কিন্তু অধিকতর দুর্ভাবনার বিষয় হল জল ও জমি নিঃশেষিতকরণ ও ইহাদের ক্ষতিসাধন। 

ভারতব্যাপী ভূগর্ভস্থ জলস্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় এই সমস্যা সংকট হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। আধুনিক নিবিড় কৃষি, শিল্প এবং নগরসভ্যতার ক্রমবর্ধমান চাহিদাপূরণের তাগিদে হাজার-হাজার বছর ধরে সঞ্চিত ভূগর্ভস্থ জলসম্পদ কয়েক দশকেই যেভাবে হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে, তা যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নদীর জলধারার উপর বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে, জলধারার গতিপথ পৃথক পথে প্রবাহিত করা হচ্ছে। তারফলে নদীর অববাহিকা অঞ্চলের ইকোলজির প্রভূত ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। শহরাঞলে অনেক জলাভূমিকে ভরাট করে অট্টালিকা গড়ে তােলা হচ্ছে। তারফলে বৃষ্টির ও অন্যান্য জমা জল নিষ্কাশনের স্বাভাবিক নালা-নর্মা জল টেনে বের করার ক্ষমতা হারাচ্ছে। বর্ষায় বসতিগুলি জলে ডুবছে।

 ভূপৃষ্ঠের জমিরও ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ জলের মত ভূপৃষ্ঠের জমিও তৈরি হয়েছে। হাজার-হাজার বছর ধরে। এই জমি কৃষিকর্মের অমূল্য সম্পদ। ভূমিক্ষয়, জমা জলে এবং লবণাক্তকরণের কারণে জমির ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। খারাপ পরিবেশ পরিচালনার জন্যই এ সব হচ্ছে। কৃষিজমির ক্ষয়ক্ষতির আর একটি কারণ হল অট্টালিকা নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক প্রয়ােজনপূরণের জন্য ব্যাপক হারে ইট তৈরি।

আবার কৃষিজমির আয়তন বৃদ্ধি এবং নতুন বসতি স্থাপনের জন্য বনভূমি, তৃণভূমি, জলাভূমি প্রভৃতির। উপর মানুষের দখলদারি ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে ইকোলজি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। জীবজন্তুর বেশকিছু প্রজাতি চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে বা অনুরূপ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও এ কথা । সমভাবে প্রযােজ্য। তবে সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর কিছু কিছু অঞ্চলের মত ভারতের কোথাও কোথাও বনসৃজনের ও সবুজায়নের পরিকল্পনা গৃহীত ও রূপায়িত হচ্ছে।

(২) পরিবেশ দূষণ : প্রকৃত প্রস্তাবে দূষণ হল বায়ু, জল ও মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব বৈশিষ্ট্যসমূহের এক অবাঞ্ছিত পরিবর্তন। এই পরিবর্তন প্রাণীর, শিল্প প্রক্রিয়ার বা কাঁচামালসমূহের মধ্যে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। মানুষের উদ্যোগ-আয়ােজনের দ্বারা উৎপাদিত উপাদানসমূহের মাধ্যমে পরিবেশের যে-কোনাে অংশ দূষিত করা, ক্ষতিকরভাবে পরিবর্তন করা বা অপবিত্র করাকেই বলে পরিবেশ দূষণ। জাতীয় পরিবেশ গবেষণা পর্ষদ’ (National Environmental Research Council)-এর অভিমত অনুযায়ী ক্ষতিকর কাজকর্মের বর্জ্য উৎপাদন হিসাবে বিভিন্ন বস্তু বা শক্তির সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত বর্জ্য প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ক্ষতিকর পরিবর্তন সূচিত করে। পরিবেশ দূষণের ফলে বাস্তুতন্ত্রের সংকট সৃষ্টি হয়। বায়ু, ভূমি, মৃত্তিকা, জল—মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এগুলি একান্তভাবে প্রয়ােজন। দুর্ভাগ্যবশত এগুলি দূষিত হচ্ছে। বর্তমানে তা সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে মানুষের প্রয়ােজন পূরণের জন্য সুস্থায়ী উন্নয়ন ছাড়াই নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং কলকারখানা স্থাপনের ফলে বিভিন্ন প্রকারে পরিবেশ দূষণ। সংঘটিত হচ্ছে। যেমন-বায়ুদূষণ, জলদূষণ, শব্দদূষণ, মৃত্তিকা দূষণ, তেজস্ক্রিয় দুষণ, কীটনাশক দূষণ প্রভৃতি। সমস্ত দূষণের ফলে পরিবেশের অবক্ষয় হয় এবং যার কু-প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে ও সমাজে বসবাসকারী মানুষ ও জীবজন্তু এর শিকার হয়।

পরিবেশ দূষণ ও জনস্বাস্থ্য : ১৯৭২ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ মানব পরিবেশের উপর। =টি সম্মেলন আহ্বান করে। এই সম্মেলনে মানবজাতির সুথ অস্তিত্বের পক্ষে বিপদস্বরূপ পরিবেশের। neকলতার প্রতি সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। বিশ্বস্বাথ্য সংগঠন (WHO World Health anisation) মানুষের স্বাথ্যের পক্ষে পরিবেশের প্রতিকূলতার উপর একটি ব্যাপক সমীক্ষা সম্পাদনের। ভঙ্গ করে। নিজের পরিবেশকে দূষিত করার ব্যাপারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষই দায়ী। নির্বিচার শিল্পায়ন, নগরায়ণ প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে মানুষই তার পরিবেশকে দূষিত ও প্রতিকূল করে তুলেছে। মানুষের খারাপ শরীর-স্বাস্থ্যের কারণ মূলত তার দূষিত পরিবেশের মধ্যেই নিহিত আছে। জলে দূষণ, বায়ুতে দূষণ, মাটিতে দুষণ, নিম্নমানের আবাসন, জীবজন্তুর খােয়ার প্রভৃতি পরিবেশগত প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষের খারাপ শরীর-স্বাস্থ্যের কারণ বর্তমান। দুষিত ও প্রতিকূল পরিবেশ মানুষের শরীর-স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

দষণের সমস্যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে। আমাদের বাসভূমি, পানীয় জল, বাতাস, শব্দ সবকিছু সাম্প্রতিকালে দূষিত হয়ে পড়ছে। কঠিন, তরল, বায়বীয় সকল পদার্থের উপরই দষণ তার থাবা বসিয়েছে। শুধু তাই নয়, শব্দদূষণ ঘটছে, ঘটছে আণবিক দূষণ। এই সমস্যা সংকট হিসাবে । দেখা দিয়েছে। এবং এই সংকট সম্পর্কে সমাজতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ, প্রশাসক এবং পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে ভাবিত। মানবসভ্যতার এই সংকট নিবারণের উপায় অন্বেষণে তারা সচেষ্ট।

উদ্ভিদজগতের উপর দূষণের প্রভাব : পরিবেশ দূষণের প্রতিকুল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রাণীজগতের। সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভিদজগতের উপরও পড়ে। বৃক্ষরােপণের হাজার হাজার একর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আকরিক ধাতু প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত কারখানা এবং সিলভার ডাই অক্সাইড প্রস্তুতকারী কারখানার বর্জ্যের দ্বারা। প্লাসটিক প্রস্তুতকারী রাসায়নিক উপাদানকারী কারখানার ধোয়া তুলাগাছ ও গােলাপ গাছের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বাস, ট্যাক্সি, ট্রাক প্রভৃতি গাড়ি ডিজেল-পেট্রোল পুড়িয়ে যে ধোঁয়া ছাড়ে তা দিবালােকে বিষাক্ত গ্যাসে পরিণত হয়। এই বিষাক্ত গ্যাস বিভিন্ন খাদ্যশস্যের গাছ, ফলমূল, ফুলের গাছ, সজীর গাছ প্রভৃতি স্পর্শকাতর বিভিন্ন গাছের উপর প্রতিকুল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

(৩) বিশ্ব উয়ায়ন : কার্বন ডাইঅকসাইড, মিথেন এবং অন্যান্য কিছু গ্যাস নির্গমনের ফলে ‘গ্রিন হাউস’ ক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। যা সূর্যালােকের তাপকে শুষে নেয়, কিন্তু ছড়িয়ে যেতে দেয় না। এই কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে এবং মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করে। তারফলে সমুদ্রের জলস্তর স্ফীত হতে শুরু করে। সমুদ্রের তটবর্তী নিচু এলাকাগুলি জলের তলায় চলে যায়। এ সবের পরিণামে ইকোলজিমূলক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।

বিশ্ব উয়ায়নের পরিণামে আরও বিপদমূলক আশঙ্কার কথা বলা হয়। বিশ্ব উয়ায়নের কারণে বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার অস্বাভাবিকতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে এবং দিচ্ছেও। বৃষ্টিপাতের সময় এবং পরিমাণে অনিশ্চয়তা এ দেশের কৃষিকর্ম ও কৃষি উৎপাদনকে প্রতিকূলভাবে প্রভাবিত করছে। অতিবৃষ্টি এবং অনাবৃষ্টি— উভয় ধরনের অস্বাভাবিকতাই বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতে পারে এবং করছে।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment