পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্র প্রকাশনায় রামমােহনের অবদান সংক্ষেপে লেখাে | পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে রামমােহনের ভূমিকা লেখাে
উত্তর :
পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্র প্রকাশনায় রামমােহনের অবদান :
ভারতবাসীর জাতীয় জীবনের উন্নতিসাধনের প্রথম পথিকৃৎ রামমােহন রায়। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তার আবির্ভাব। প্রাচ্যবিদ্যা ও পাশ্চাত্যবিদ্যা উভয়েই ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। তিনি সংস্কারমূলক পরিকল্পনার সাপেক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলতে সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদন করেন।
রামমােহন রায়ের সংবাদপত্র প্রকাশনার গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ভারতীয় ভাষায় পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা। এদেশে সংবাদপত্র প্রকাশের পর প্রায় চার দশক ইংরেজি ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশিত হত। তা মূলত এদেশে আসা ব্রিটিশরাই পাঠ করত। কিন্তু এদেশীয়দের জন্য মাতৃভাষার সংবাদপত্র প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা নেন।
(1) 1818 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে “দিগদর্শন’ নামে একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু হয়। এ ছাড়া 1818 খ্রিস্টাব্দে 15 মে প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র বাঙ্গাল গেজেটি। এই পত্রিকাটিতে রাজা রামমােহন রায়ের সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ নামের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
(2) 1820 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে রামমােহনের সম্পাদনায় ‘সম্বাদ কৌমুদি’ নামে একটি বাংলা
সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়।
(3) 1822 খ্রিস্টাব্দে 12 এপ্রিল তিনি প্রকাশ করেন ফরাসি ভাষায় একটি সাপ্তাহিক
মিরাৎ-উল-আখবার। এই পত্রিকাটি প্রায় এক বছরকাল চলেছিল।
(4) 1829 খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন।
(5) এই পত্রিকার পাশাপাশি তিনি নিজস্ব মতপ্রকাশের জন্য ছােটো ছােটো বই, কয়েকটি আলােচনা পুস্তক রচনা করেন। সমসাময়িক তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা হল ব্রাম্মণসেবধি।
রামমােহন রায়ের সমস্ত পত্রপত্রিকার মধ্যে সম্বাদ কৌমুদি ছিল বেশ উচ্চমানের। সংবাদপত্র-সংক্রান্ত প্রসঙ্গে রামমােহনের উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল— 1823 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সরকার সংবাদপত্র স্বাধীনতা সংকোচন করলে তিনি সরকারি অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে যান এবং পরে প্রিভিকাউন্সিলে আবেদন জানান। দীর্ঘ লড়াই-এর পর গভর্নর জেনারেল চার্লস মেটকাফ 1835 খ্রিস্টাব্দে ‘প্রেস নিয়ন্ত্রণ আইন প্রত্যাহার করে নেন। এটি ছিল ব্রিটিশ বিরােধী আইনি পদক্ষেপ।
পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে রামমােহনের ভূমিকা :
শিক্ষাক্ষেত্রে রামমােহন রায় পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে প্রথম স্বাগত জানিয়েছিলেন। ভারতীয় টোল পণ্ডিতরা শিক্ষার্থীর জীবনের অমূল্য সময় কিছুটা নষ্ট করতেন। এ ছাড়া পাঠ্যদানের বিষয়ও ছিল না আধুনিক। তাঁর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিষয়ক জ্ঞান ছিল অপরিসীম। তিনি প্রথম পাশ্চাত্য বিষয়ক জ্ঞানের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন প্রাচ্য সংস্কৃতিতে গভীর সত্য ও মহত্ত্ব নিহিত থাকলেও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা থেকে দূরে থাকার ফলে ভারতবাসীর মধ্যে কুসংস্কারের প্রাধান্য দেখা দিয়েছে। তাই প্রাচ্য সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার যেমন প্রয়ােজন, তেমন। পাশ্চাত্য সাহিত্য, বিজ্ঞানচর্চা দরকার।
তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছিলেন।
(1) তিনি 1823 খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি লিখে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের জন্য সরকারি অর্থ সাহায্যের জন্য অনুরােধ জানান।
(2) পাশ্চাত্য ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য আলেকজান্ডার ডাফকে তিনি জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠায় সহযােগিতা করেছিলেন।
(3) 1822 খ্রিস্টাব্দে ইউনিটেরিয়ান অ্যাসােসিয়েশন পরিচালনায় তিনি ইঙ্গ-বৈদিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়ের কার্যকরী সমিতিতে ডেভিড হেয়ার এবং রেভারেন্ড অ্যাডামকে যুক্ত করেন। এ ছাড়া তিনি মনে করতেন ভারতীয়দের শিক্ষাদানের জন্য ইউরােপীয় শিক্ষক নিয়ােগ করা প্রয়ােজন।
(4) তিনি ভারতীয়দের গণিত, দর্শন, রসায়ন, অস্থিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা পড়ানাের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। তিনি ভারতীয় পরাবিদ্যাচর্চার অসারতা বুঝেছিলেন। তাই রামমােহনের প্রতিষ্ঠিত বেদান্ত কলেজেও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা ও ইংরেজিচর্চার ব্যবস্থা করা হয়। রামমােহন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতির মধ্যে প্রথম মেলবন্ধনে সচেষ্ট হন। তাই তিনি প্রাচ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের নতুন অগ্রদূত। তিনি নতুন ভারতের আলাের দিশারি।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।