প্রাচীন যুগের বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো
উত্তর :
প্রাচীন যুগের বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :
আর্যসভ্যতার যুগে প্রবর্তিত এবং আনুমানিক 2000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 300 খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের বেদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈদিক শিক্ষা নামে অভিহিত করা হয়। পরম জ্ঞানলাভ এবং পার্থিব দায়িত্ব পালনের শিক্ষা—এই দুটি বিষয় ছিল প্রাচীন যুগের বৈদিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এই শিক্ষার মূল আদর্শ ছিল আত্মােৎসর্গের আদর্শ। নীচে প্রাচীন যুগের বৈদিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করা হল—
[1] গুরুকুল : প্রাচীন কালের বৈদিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হল গুরুগৃহ বা গুরুকুল বা গুরুর আশ্রম। উপনয়ন অনুষ্ঠানের পর শিষ্যরা স্থায়ীভাবে বসবাসের এবং শিক্ষালাভের জন্য গুরুকুলে হাজির হত। এক-একটি স্থানে এক-একজন গুরুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত বৈদিক শিক্ষার আবাসিক আশ্রম গুরুকুল।
[2] ব্রম্মচর্য পালন : বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা উপনয়নের মাধ্যমে কোনাে গুরুর কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করত এবং উপনয়নের সময় গুরু শিক্ষার্থীকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণের কালে ব্রম্মচারী হিসেবে দ্বিতীয় জন্ম দিতেন। গুরুগৃহে বসবাসের সময় শিষ্যকে কঠোরভাবে ব্ৰম্মচর্য পালনের নিয়মকানুন ও আচার-আচরণ মেনে চলতে হত। কতকগুলি শারীরিক ও আধ্যাত্মিক নিয়মনিষ্ঠা পালনের মধ্য দিয়ে শিষ্যের অধ্যয়ন বা শিক্ষালাভের কাজ চলত।
[3] শিক্ষাকাল : বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে গুরুগৃহে বা আশ্রমে বারাে বছর কাল ধরে ব্ৰম্মচর্য পালন করতে হত। ওই সময়কালের মধ্যে গুরু শিষ্যদের বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শিষ্যের শিক্ষাক্রমের সমাপ্তি ঘটত।
[4] পাঠক্রম: বৈদিক শিক্ষার পাঠক্রমে মূল বিষয় ছিল বেদ পাঠ ও বেদ অনুশীলন। বেদ ছাড়াও আরও কতকগুলি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পারদর্শী করে তােলা হত। এগুলি হল—তর্ক, ছন্দ, ব্যাকরণ, কল্প, শিক্ষা, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদি। পরবর্তী পর্যায়ে বৈদিক, ব্রাহ্মণ্য সমাজে বর্ণাশ্রম প্রথা প্রচলিত হওয়ায় শূদ্র ব্যতীত অন্যান্য তিন বর্ণের জন্য বৃত্তি অনুসারে পৃথক পৃথক বিষয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন—(1) ব্রাহ্মণ বর্ণের শিক্ষার্থীদের পাঠক্রমে স্থান দেওয়া হয়—বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ, নক্ষত্রবিদ্যা, ব্ৰম্মবিদ্যা, পুরাণ, ইতিহাস ইত্যাদি। (2) ক্ষত্রিয় বর্ণের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠক্রমে রাখা হয়— যুদ্ধবিদ্যা, অস্ত্রবিদ্যা, রাজনীতি, দণ্ডনীতি, নীতিশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ ইত্যাদি এবং (3) বৈশ্য বর্ণের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়—কৃষিবিদ্যা, পশুপালন, বাণিজ্য-সংক্রান্ত পাঠ, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদি।
[5] শিখন কৌশল : বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা শিখনের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় অনুসরণ করত। এগুলি হল–শ্রবণ, মনন এবং নিবিষ্টচিত্তে ধ্যান।
[6] শিক্ষার্থীর কার্যাবলি : বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুর আশ্রমে আবাসিক হয়ে জীবনযাপনকালে শিষ্যকে অধ্যয়নের পাশাপাশি অনেকগুলি দায়িত্ব বা কর্তব্যপালন করতে হত। এই দায়িত্ব বা কর্তব্যগুলি হল—নিয়মিত গুরুর সেবা করা, আশ্রম বা গুরুগৃহ পরিষ্কার করা, পূজার জন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা, গােপালন করা, গুরুর পরিবারের জন্য বা আশ্রমের জন্য ভিক্ষা করা, গুরুর যাবতীয় নির্দেশ পালন করা ইত্যাদি।
[7] গুরুকেন্দ্রিকতা : বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় আশ্রম বা গুরুগৃহের প্রধান ছিলেন গুরু। তাই আশ্রমের যে-কোনাে ব্যাপারে গুরুর কথাই ছিল শেষ কথা। কোনাে ব্যাপারেই শিক্ষার্থী বা শিষ্যদের কথা বলার অধিকার ছিল না।
[8] গুরু-শিষ্য সম্পর্ক : বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। গুরু শিষ্যকে নিজের সন্তানের মতাে করে ভালােবাসতেন এবং শাসন করতেন। শিষ্যরাও গুরুকে পিতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করত এবং সমীহ করে চলত।
[9] সর্বজনীনতার অভাব : বৈদিক ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় শুদ্রদের পঠনপাঠনের অধিকার দেওয়া হত না। কেবল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য বর্ণের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সুযােগ লাভ করত। তাই বলা যায়, বৈদিক শিক্ষা হল সংরক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা। এর অন্যতম ত্রুটি হল সর্বজনীনতার অভাব।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।