প্রাচীন রােম ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থান ও বিস্তার নীতির তুলনামূলক আলােচনা করাে

প্রাচীন রােম ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থান ও বিস্তার নীতির তুলনামূলক আলােচনা করাে (৮ নম্বরের প্রশ্ন)

উত্তর:

সূচনা: ভূমধ্যসাগরের তীরে ইতালির আল্পস পর্বতের পাদদেশে টাইবার নদীর দক্ষিণ তীরে গড়ে ওঠা রােমনগরীকে ঘিরেই খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে যে সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তা রােমান সাম্রাজ্য নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে রােমান সম্রাটরা সামরিক অভিযানের মাধ্যমে রােম সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটান। রােম সাম্রাজ্যের বিস্তারে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন জুলিয়াস সিজার ও অগাস্টাস সিজার।

জুলিয়াস সিজার: ৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস কনসাল নিযুক্ত হন। তিনি গল অভিযান করে অসামান্য সাফল্য লাভ করেন। নীলনদের যুদ্ধে তিনি মিশরের রাজা ত্রয়ােদশ টলেমিকে পরাজিত করে মিশর জয় করেন। সেখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পর রােমের পঞ্জিকা ও ক্যালেন্ডার সংস্কার করেন। একের পর এক অভিযানে সাফল্য লাভ করে তিনি রােমে বার্তা পাঠান, Veni, Vedi, Vice অর্থাৎ এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। সিজারের সাফল্যের ফলে তাঁর নেতৃত্বে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

অগাস্টাস সিজার: সিজারের ভাগিনেয় ও পালিতপুত্র অক্টাভিয়ান নাম গ্রহণ করে রােমের সিংহাসনে বসেন। তিনি রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে রােম সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করেন পশ্চিম এশিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিস্তার নীতি: কুষাণ ও সাতবাহন রাজ্যের পতনের পর ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীগুপ্ত। তবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রসারে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের।

প্রথম চন্দ্রগুপ্ত: প্রথম চন্দ্রগুপ্ত যুদ্ধের পরিবর্তে বিবাহের মাধ্যমে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটান। লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমার দেবীকে বিবাহ করায় লিচ্ছবি রাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। সম্ভবত, উত্তরে বেনারস থেকে দক্ষিনে মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ এবং পশ্চিমে বাকাটক থেকে পূর্বে সমতট বাদে বাংলা তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল।

সমুদ্রগুপ্ত: গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রসারে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব ছিল সমুদ্রগুপ্তের। তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারত অভিযানে পৃথক নীতি গ্রহণ করেছিলেন। উত্তর ভারতের নয়জন রাজাকে পরাজিত করে তাঁদের রাজ্য সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে ১২ জন রাজাকে পরাজিত করলেও তাঁদের রাজ্য গ্রাস করেননি। ফলে উত্তর ভারত গুপ্ত সাম্রাজ্য কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে শাসিত হলেও দক্ষিণ ভারত গুপ্ত শাসনমুক্ত থাকে।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত: সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেন। তাঁর সামরিক কৃতিত্ব তেমন উল্লেখযােগ্য ছিল না। শুধুমাত্র শক রাজাদের পরাজিত করে শক রাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তবে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন।

তুলনা: রােম ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রসারের চরিত্র এক রকম ছিল না। রােম সাম্রাজ্যের বিস্তার নীতি অনেক বাধা পেয়েছিল রােমের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বের ওপর। কিন্তু গুপ্ত সাম্রাজ্য তেমন কোনাে অন্তর্দ্বন্দ্বে সম্মুখীন হয়নি। সেখানে চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল। কিন্তু রােমে কখনাে প্রজাতন্ত্র, কখনাে একনায়কতন্ত্র এবং কখনাে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় রােম সাম্রাজ্যে নৈরাজ্য দেখা দেয় । গুপ্ত সাম্রাজ্য সর্বদা একই রাজবংশের দ্বারা শাসিত হয়েছিল কিন্তু রােম সাম্রাজ্য শাসিত হয় ভিন্ন ভিন্ন শাসক কর্তৃক।
রােম সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল সম্পূর্ণ সামরিক বলে। রােম সাম্রাজ্য ইটালির সীমানা পেরিয়ে শুধুমাত্র ইউরােপে বিরাট অংশে বিস্তার লাভ করেনি, মহাদেশের সীমানা অতিক্রম করে গ্রাস করেছিল আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার ভূখণ্ড। তুলনায় গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিল অতিক্ষুদ্র। এই সাম্রাজ্য ভারতের সীমানা অতিক্রম তাে দূরের কথা, সমগ্র ভারতে বিস্তার লাভ করতে পারেনি। গুপ্ত সাম্রাজ্য শুধুমাত্র সামরিক বলে নয়, কূটনৈতিক এবং বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমেও প্রসার লাভ করে। সর্বোপরি, গুপ্ত সাম্রাজ্য রােম সাম্রাজ্যের মতাে স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি।

উপসংহার: রােম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও অবসান ইউরােপের ইতিহাসকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছিল। রােম সাম্রাজ্যের পতন ইউরােপের ইতিহাসে যুগ নির্দেশক ছিল। তুলনায় গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও পতন ভারতীয় ইতিহাসে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। সবদিক দিয়ে বিচার করলে রােম সাম্রাজ্যের সঙ্গে গুপ্ত সাম্রাজ্যের তুলনা করাই চলে। তুলনা চলে সমানে সমানে, অতিবৃহৎ এবং অতিক্ষুদ্রের মধ্যে তুলনা চলে না।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment