প্রাথমিক শিক্ষা ও স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের অবদান আলােচনা করাে।
উত্তর :
প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের অবদান :
বিদ্যাসাগর ছিলেন নবজাগরণের পুরােধা। তাঁর শিক্ষা, সমাজ-সংক্রান্ত সংস্কার আজ যুগােপযােগী ও সমানভাবে সমাদৃত। তিনি দেশীয় শিক্ষার করুণ অবস্থা উপলব্ধি করেন এবং তা সংস্কারে সচেষ্ট হন। 1853 খ্রিস্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা উল্লেখ করে তৎকালীন বড়ােলাট লর্ড ডালহৌসির কাছে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। বড়ােলাট তাঁর প্রতিবেদনের সুপারিশগুলি সমর্থন করেন। তা হল —
[1] শিক্ষার মাধ্যম : তিনি প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা ব্যবহারের পক্ষে অভিমত দেন। ইংরেজি শাসকের ভাষা-ইংরেজি প্রত্যেকের জানা উচিত। তা কিন্তু মাতৃভাষা শিখনের পূর্বে নয়।
[2] প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলা ভাষায় অবদান : প্রাথমিক শিক্ষাপ্রসারে তার অনবদ্য সৃষ্টি হল বর্ণপরিচয়। যা অক্ষর জ্ঞানের প্রথম সােপান। তিনি বাংলা ভাষায় যতি চিহ্নের প্রচলন করেন। বর্ণের দুর্বোধ্যতা সরল করেন। এ ছাড়া ভাষা শিক্ষার জন্য কথামালা’, ‘বােধােদয়’ প্রভৃতি রচনা করেন। তিনি কথ্য ভাষার ওপর জোর দেন। তিনি ব্যাকরণ শিক্ষার জন্য বাংলা ভাষায় লেখেন— ব্যাকরণ কৌমুদী, উপক্রমণিকা ইত্যাদি।
[3] পাঠ্যবিষয় : প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে পড়াশােনার জন্য বিদ্যাসাগর, সাধারণ গণিত, ভূগােল, ইতিহাস, জীবনবৃত্তান্ত, বিজ্ঞানের নানা শাখা ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ করেন।
[4] মডেল স্কুল স্থাপন : বাংলার বিভিন্ন জেলা যথা—মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া প্রভৃতি স্থানে 1855 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1856 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় 20টি মডেল স্কুল গড়ে ওঠে। তিনি এই বিদ্যালয়ে একজন প্রধানশিক্ষক ও দুজন সহকারী শিক্ষক নিয়ােগের কথা বলেন। এই-সমস্ত প্রতিষ্ঠানের কোনাে কোনােটিতে তিনি পুরাে নির্মাণ খরচ বহন করেছিলেন।
[5] শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা : উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া শিক্ষাদান অসম্ভব। তাই তাঁর প্রচেষ্টায় 1855 খ্রিস্টাব্দে শিক্ষক-শিক্ষণের জন্য স্থাপিত হয়। তার অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত হন মনীষী অক্ষয়কুমার দত্ত।
[6] পরিদর্শন ব্যবস্থা : বিদ্যালয়গুলি পরিদর্শনের জন্য দুটি জেলা প্রতি একজন পরিদর্শক নিয়ােগের সুপারিশ করেন তিনি। সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ থাকাকালীন তিনি নিজেও অবৈতনিক পরিদর্শক ছিলেন।
উপসংহার :
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি ও অগ্রগতিতে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর শিক্ষামূলক সংস্কার বাঙালি জাতিকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের অবদান :
বিদ্যাসাগর হলেন ভারতীয় নারীমুক্তির অগ্রদূত। গোঁড়া হিন্দুদের তৎকালীন সমাজে নারীর কোনাে মর্যাদা ছিল না এবং শিক্ষায় সম্পত্তিতে কোনাে অধিকার ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীশিক্ষার ব্যাপারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
[1] সামাজিক ধারণার পরিবর্তন : তৎকালীন সময় এ দেশ ছিল কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। নারীর কোনাে মর্যাদা ছিল না। কোনাে বিষয়ে অধিকার ছিল না। গোঁড়া হিন্দুদের ধারণা ছিল— যে-মেয়ে লেখাপড়া শিখবে সে-মেয়ে খুব শীঘ্রই বৈধব্যের শিকার হবে। এইসব ধারণা অনর্থক, ভিত্তিহীন—এ ব্যাপারে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন এবং ধারণা পরিবর্তনে সচেষ্ট হন।
[2] বিদ্যালয় স্থাপন : খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা বঙ্গদেশে নারীশিক্ষার আন্দোলন শুরু হয়। তিনি মেয়েদের বিদ্যালয় পাঠানাের ক্ষেত্রে যেমন সচেষ্ট ছিলেন তেমন বিদ্যালয় গড়ে
তুলতে উদ্যোগী হন। 1849 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত “হিন্দু ফিমেল স্কুল’ (যা পরবর্তীকালে বেথুন স্কুল)। এই স্কুলের তিনি সম্পাদক ছিলেন। এই সময় তিনি বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রচেষ্টায় হুগলি জেলায় 23টি, বর্ধমান জেলায় 11টি, মেদিনীপুর জেলায় 3টি ও নদিয়ায় এটি মােট 35টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
[3] নারীশিক্ষায় আর্থিক সহায়তা : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে বহুদিন সরকারি সাহায্য না-পাওয়ার জন্য—বিদ্যাসাগর নিজেই ব্যয়ভার বহন করতেন। নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারি বাহাদুর যাতে আর্থিক সহায়তা দান করেন তার জন্য আবেদন করেন। তিনি নারীশিক্ষাভাণ্ডার’ নামে একটি অর্থভাণ্ডার গড়ে তােলেন। যার সাহায্যে প্রতিষ্ঠানের খরচ চলবে। এ ছাড়া তিনি বহু শিক্ষকের বেতন নিজেই দিতেন।
উপসংহার :
বাংলার নারী বিদ্যাসাগরের কাছে আজও ঋণী। আজ যেটুকু নারীর মর্যাদা বা শিক্ষিত হয়ে ওঠা, তার পিছনে যে-সমস্ত মনীষী অগ্রণী— তাঁদের অন্যতম হলেন বিদ্যাসাগর।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।
Helpful 🎆🎇🪄🧿🪔💡💡🇮🇳