প্রয়াত বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখােপাধ্যায়
ভূমিকা: স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে আবার ইন্দ্রপতন ঘটল। গত ৩১শে আগস্ট, ২০ দিল্লির আর্মি হাসপাতালে জীবনাবসান হল প্রাক্তন বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখােপাধ্যায়ের। প্রজ্ঞাবান এক দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনের বর্ণময় উদ্যাপন কীভাবে ধাপে ধাপে ভারতীয় প্রশাসনের চূড়ান্ত অবস্থানে উত্থান ঘটল সে বিষয়ে প্রতিটি বাঙালি পাঠকের কৌতুহল স্বাভাবিক।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়: ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর বীরভূম জেলার কীর্ণাহার সন্নিকটস্থ প্রত্যন্ত মিরিটি গ্রামে প্রণব মুখােপাধ্যায়ের জন্ম হয়। পিতা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও প্রাক-স্বাধীনতা যুগের বঙ্গ বিধান পরিষদের দু’বারের সদস্য-কামদা কিংকর মুখােপাধ্যায়। মাতা-রাজলক্ষ্মী দেবী।
শিক্ষা জীবন: প্রণবের প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয় গ্রামের ব্রাহ্মণপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে ৫ কিমি দূরে কীর্ণাহারের শিবচন্দ্র হাইস্কুলে যােগ দেন। বর্ষার সময় তাকে স্কুল ব্যাগ মাথায় নিয়ে সাঁতরে নদী পেরিয়ে স্কুল যাতায়াত করতে হত। বিদ্যালয় পাঠ সফলভাবে শেষ করার পর সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বাংলা সাম্মানিক সহ স্নাতক হন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান—দু’টি বিষয়ে এম.এ পাশ করেন। পরে আইনে এলএলবি. ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশাগত কর্মজীবন: তার পেশাগত কর্মজীবন খুব বিস্তৃত না হলেও বেশ বৈচিত্র্যে ভরা। একেবারে প্রথম জীবনে বেশ কিছুদিন পােষ্ট এন্ড টেলিগ্রাফ বিভাগে আপার ডিভিসান ক্লার্কের পদে নিয়ােজিত ছিলেন। পরে সে কাজ ছেড়ে দিয়ে হাওড়া জেলার বাকড়া ইসলামিয়া হাইস্কুলে এবং আমতার তাজপুর এম এম ইনিস্টিউশানে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তারপর স্কুল ছেড়ে দক্ষিণ ২৪ পরগণার আমতলার নিকট প্রতিষ্ঠিত বিদ্যানগর কলেজে ১৯৬৩-১৯৬৯ পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। তারপর এখানে থাকাকালীন তার রাজনীতির বন্ধুর পথে যাত্রা শুরু হয়।
রাজনৈতিক জীবন: বিদ্যানগর কলেজে শিক্ষকতা করা কালীন ১৯৬৬ সালে তিনি তৎকালীন অজয় মুখার্জী পরিচালিত বাংলা কংগ্রেসে যােগদান করেন। পরে ১৯৬৯-এ বাংলা কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভার সদস্য হন। পরে মূল কংগ্রেসে যােগদান করেন। ১৯৭৩-এ ইন্দিরাপন্থী মন্ত্রীসভায় শিল্প প্রতিমন্ত্রী হন। এইভাবে কংগ্রেসের টিকিটে ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৯-তে চারবার রাজ্যসভা এবং ২০০৪ ও ২০০৯-তে দু’বার জঙ্গীপুর থেকে লােকসভা সদস্য নির্বাচিত হন। এই সময় কালে ১৯৮২-তে ইন্দিরা মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী হন। ১৯৮৪-তে ইন্দিরার মৃত্যুর পর যে কোনাে কারণে তৎপুত্র রাজীব গান্ধির বিরাগভাজন থাকায় তাকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। সে সময় প্রণব নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। যদিও সে দল বেশিদিন টেকেনি। রাজীবের দুর্ঘটনায় মৃত্যর পর তিনি পুনরায় কংগ্রেসে ফিরে আসেন। এরপর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে নরসীমা রাও মন্ত্রীসভায় যােজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদে যােগদান করেন। তারপর ১৯৯৫-তে তার দ্বিতীয় মন্ত্রীসভায় বিদেশমন্ত্রী, ২০০৪-এ মনমােহন সিং মন্ত্রীসভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ২০০৬-এ আবার বিদেশমন্ত্রী এবং ২০০৯-এ তৃতীয় বারের জন্য অর্থমন্ত্রী হন। এবং শেষ পর্যন্ত ১৯১২-১৭ পর্যন্ত পাঁচ বছর সময়কালে ভারতের ত্রয়ােদশ রাষ্ট্রপতি পদ অলংকৃত করেন।
সম্মান প্রাপ্তি: এই শিক্ষিত প্রজ্ঞাবান দুরন্ত মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী ব্যক্তিটি স্বাভাবিকভাবেই দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বহু সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে ২০০৮ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ ও ২০১৯ সালে ‘ভারতরত্ন’ উপাধি প্রাপ্তি অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য।
ব্যক্তিগত চরিত্র: বাঙালি হয়েও তিনি ছিলেন বহুত্ববাদী ভারতের যথার্থ প্রতিভূ। পরমতসহিষ্ণুতা, বিরােধী রাজনীতিবিদদের প্রতি সম্মানবােধ, প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তিগত সংযম, শীতল মস্তিষ্ক, গভীর বিশ্লেষণী বুদ্ধি, সংকটপূর্ণ সময়ে সঠিক পথ সন্ধানী দিশা, প্রতিশােধস্পৃহাহীনতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিরল গুণের আকর হিসাবে তাকে ‘রাজনীতির চাণক্য’ বলা হত। আজকের এই ষণ্ডামার্কা পেশি প্রদর্শক রাজনীতির যুগে তার কথা নিশ্চয়ই সকলের খুব মনে পড়বে।
উপসংহার: বিতর্ক বিসংবাদের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া এই ছােট চেহারার বড় মানুষটি এখন থেকে আরও দীর্ঘদেহী রূপে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে দীর্ঘদিন দীপ্যমান থাকবেন সন্দেহ নেই।
আরো পড়ুন
উন্নয়ন বনাম পরিবেশ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞাপন ও আধুনিক জীবন | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
দেশপ্রেম বনাম বিশ্বপ্রেম | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।