প্রশ্নঃ আইনের অনুশাসন কাকে বলে ? এর মূলনীতি গুলি লেখো ।
উত্তরঃ-
আইনের অনুশাসন :
ব্যক্তিস্বাধীনতার পীঠস্থান হল ব্রিটেন। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে লিখিত সংবিধানের মাধমে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষিত হয়। ব্রিটেনে লিখিত সংবিধান নেই। অথচ সেখানকার নাগরিকরা অনেক দেশের তুলনায় অনেক বেশী পরিমাণে অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে। এর কারণ হল –আইনের অনুশাসন বা Rule of Law, যাকে তারা ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে মনে করে।
আইনের অনুশাসনের অর্থঃ
আইনের অনুশাসনের অর্থ হল – আইনের প্রাধান্য। অর্থাৎ সকলে আইনের অধীনে থাকবে। আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান মর্যাদা পাবে। কার্টার, রেণী ও হার্জ (Carter, Ranney and Herz)-এর ভাষায়, “The Government and its agents, as well as individual citizen are subject to laws”। আইনের প্রাধান্যের ধারণাটি ১৯১৫ সালে মহাসনদে জন্ম নিয়েছিল। কারণ এই সনদে ঘোষণা করা হয়, বিনা বিচারে কোন স্বাধীন প্রজাকে আটক করা যাবে না।
তারপরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘোষণায় এই নীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ডাইসি তিনটি নীতির কথা উল্লেখ করেন :
প্রথমতঃ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য। প্রত্যেকে আইনের দ্বারা
শাসিত হবে। ডাইসির ভাষায়, – “Englishmen are ruled by the law and law alone” যতক্ষণ না পর্যন্ত কোন ব্যক্তি দেশের সাধারণ আদালতে সাধারণ আইন দ্বারা দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে, ততক্ষণ কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না এবং জীবন ও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
দ্বিতীয়তঃ আইনের চোখে সকলে সমান। কোন ব্যক্তি আইনের উপরে নয়। ডাইসির ভাষায়, – “No man is above law” | যার যেমন পদমর্যাদা হোক না কেন, প্রত্যেকের বিচার সাধারণ আইনের দ্বারা সাধারণ আদালতে হবে। অর্থাৎ আইনের দৃষ্টিতে সাধারণ নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ফ্রান্সে সরকারী কর্মচারীদের জন্য পৃথক আদালত আছে। কিন্তু ব্রিটেনে তা নেই ।
তৃতীয়তঃ ‘ব্রিটেনে নাগরিকদের অধিকারগুলির উৎস সংবিধান নয়। সেখানে দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন মামলায় আদালত যে রায় দিয়েছে, তার মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এটি সংবিধানের মূল নীতি।
ভারতীয় সংবিধানের অধীনে আইনের শাসনঃ
ভারতের গণতন্ত্রের বিকাশে আইনের অনুশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারতীয় সংবিধানে আইনের অনুশাসন প্রস্তাবনার অধীনে গৃহীত হয়েছে যেখানে ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা এবং সাম্যের আদর্শ নিহিত রয়েছে। সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, কেউই ভারতের সংবিধানের ঊর্ধ্বে নয়। ভারতে আইনের অনুশাসনের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অন্যান্য আইন প্রবর্তন করা হয়েছে।
ভারতের সংবিধানের তৃতীয় অংশে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নং ধারা অনুযায়ী ভারতের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ এবং ‘আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত’ হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না৷ এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে আইনের দৃষ্টিতে সমতা নীতিটি ডাইসির ‘আইনের অনুশাসন’ তত্ত্বের দ্বিতীয় নীতিরই প্রকাশ। সংবিধানের ১৯ নং ধারা ভারতের নাগরিকদের ছয়টি মৌলিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। যথা—বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতা, সংঘ বা সমিতি গঠনের স্বাধীনতা, ভারতের ভূখণ্ডের যেকোনো অংশে যাতায়াত ও বসবাসের স্বাধীনতা এবং বৃত্তি বা পেশা গ্রহণের স্বাধীনতা। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘আইন নির্দিষ্ট পদ্ধতি’ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে কোনো ব্যক্তিকে তার জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। উল্লেখ্য সংবিধান প্রদত্ত এই অধিকারগুলি আইনের অনুশাসনকেই প্রতিষ্ঠা করে। সংবিধানের ১৪, ১৯ এবং ২১ নং ধারাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মূল্যায়নঃ উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় ‘আইনের আধিপত্য’ হল লক্ষ আর ‘আইনের শাসন’ হল লক্ষ অর্জনের সর্বোত্তম হাতিয়ার। তবে, ভারতীয় সমাজে আইনের শাসন সবক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করেনি। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ বিচার বিভাগের সক্রিয়তার উপরই আইনের অনুশাসনের উপস্থিতি অনেকটাই নির্ভর করে থাকে।
Read Also
ভারতের সংবিধান প্রস্তাবনার গুরুত্ব বা তাৎপর্য আলোচনা করো
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন | Non-Aligned Movement in Bengali
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।